১৩ ডিসেম্বর মির্জাপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়েছিলো

মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:২৩ এএম, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ | ৩৪০

১৩ ডিসেম্বর মির্জাপুর মুক্ত দিবস। ৭১’র এই দিনটিতে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে মির্জাপুরের মুক্তিযোদ্ধারা মির্জাপুরকে হানাদার মুক্ত করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়। মুল বিজয়ের তিনদিন পূর্বেই মির্জাপুরবাসী স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করে। বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হতে থাকে মির্জাপুরবাসী।

দিবসটি উপলক্ষে মির্জাপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সকালে উপজেলা পরিষদ চত্বরে অবস্থিত মুক্তির মঞ্চে জাহির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ¦ মো. একাব্বর হোসেনসহ বিভিন্ন সংগঠন।

এসময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল মালেক, সাবেক মেয়র মোশারফ হোসেন মনি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক দুই কমান্ডার সরকার হিতেশ চন্দ্র পুলক, অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস, মুক্তিযেদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ। সন্ধায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল মালেক জানিয়েছেন।

৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনে মির্জাপুরের মুক্তিকামী মানুষ উজ্জীবিত হতে থাকে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নৃশংস ও বর্বর হামলা চালায়।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এ এলাকার যুব সমাজ সংঘটিত হতে শুরু করে। মির্জাপুর সদয় কৃষ্ণ মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শরীরচর্চা শিক্ষক নিরঞ্জন সাহার তত্ত্বাবধানে চলে স্থানীয় কিশোর যুবকদের প্রশিক্ষণ। কেউ কেউ কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। এছাড়া গঠন করা হয় সংগ্রাম পরিষদ।

মুক্তিযোদ্ধারা বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন ৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল প্রবেশ করবে। এর পর সংগ্রাাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ফজলুর রহমান ফারুকের (বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লী সভাপতি ) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় বাংকার খনন শুরু করে। অন্যদিকে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর একটি দল নাটিয়া পাড়ায় পজিশন নেয়।

৩রা এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক দিয়ে গোড়ান-সাটিয়াচড়া নামক স্থানে পৌঁছার পর ইপিআর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার সম্মুখিন হয়। এর পর চলে তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ২২ ইপিআরসহ ১০৭ বাঙালি নিহত হন এবং প্রায় ৩শ জন পাকসেনা হতাহত হয়। ৩ এপ্রিলের যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী মির্জাপুর থানা ও সার্কেল অফিসে ঘাঁটি গেড়ে এলাকায় জ্বালাও পোড়াও এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে।

৭ মে হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর মাওলানা ওয়াদুধ ও তার দুই ছেলে রাজাকার মাহাবুব এবং মান্নানকে নিয়ে মির্জাপুর, আন্ধরা, সরিষাদাইর গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ৩১ বাঙালিকে হত্যা করে। নিজ বাসায় আওয়ামী লীগ থাকা এবং গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আদান প্রদান করার অপরাধে মির্জাপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে জনসম্মুখে গুলি করে হত্যা করা হয় দেশ প্রেমিক মাজম আলীকে। ওই রাতেই পাক বাহিনী নারায়নগঞ্জের বানা থেকে দানবীর

রণদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবিসহ পাঁজনকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করে। আজ পর্যন্ত তাদের কোন সন্ধান মেলেনি। পরদিন ৮ মে পাকবাহিনী মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের পিতা পুষ্টকামুরী গ্রামের জয়নাল আবেদীনকে ঘরের ভেতর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানীদের উৎখাতের পালা। নভেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা মির্জাপুরকে পাক বাহিনী মুক্ত করলেও কয়েকদিনের মধ্যেই আবার পুনরায় দখল করে।

এরপর কাদেরিয়া বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের দুধর্ষ কমান্ডার শাহ আজাদ কামাল, মো. একাব্বর হোসেন (বর্তমান এমপি টাঙ্গাই ৭, মির্জাপুর) ও শহিদুর রহমান(মির্জাপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র) রবিউলসহ মুক্তিযোদ্ধারা সারাশি অভিযান চালিয়ে ১৩ ডিসেম্বর প্রাণপণ যুদ্ধ করে মির্জাপুরকে পাক বাহিনীর দখল মুক্ত করে এবং তৎকালীন সিও অফিসে (বর্তমানে ইউএনও অফিস ) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।