ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, সুস্থ ধারায় ফেরাতে হবে

শামসুল ইসলাম সহিদ
প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, শনিবার, ২ নভেম্বর ২০১৯ | ৪১৬

আমার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়–য়া ছেলে সাদিদ। পড়ার ফাকে সুজোগ পেলেই টিভির সামনে গিয়ে বসে। টিভিতে কার্টুন দেখার পাশাপশি ভারতীয় চ্যানেলে বিভিন্ন নাটকের প্রতি ভিষন ঝোক দেখে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি। ওর ঝোক পরিবর্তনের জন্য ওকে বলি বাবা এত নাটক না দেখে কিছু কিছু খবর শুনতে হয়। খবর শুনলে দেশ বিদেশের অনেক খবর জানতে পারবে। ছেলে উত্তর দেয বাবা খবর ভাল না। বললাম কেন? ছেলে বলল খুন, মারামারির খবর বেশি দেখায়। আমি বললাম কই? ছেলে বলল, ওইত একটা ছেলে খুন হয়েছে, ওর বাবা মা কান্না করছে।

বুয়েটের মেধাবি ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পর বিভিন্ন টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করে যখন খবর শুনছিলাম ঠিক তখনই ছেলের সাথে আমার এই কথোপকথন।আর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে বর্তমানে আদর্শ বিচ্যুত এবং পথ হারানো ছাত্ররাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে এই পথ হারানো রাজনীতি সম্পর্কে সারা দেশে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন নেতিবাচক বক্তব্য চলছে। আর এ জন্য দায়ী কি শুধু আমাদের ছাত্রসমাজ না কি তাদের কে পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী কোন শক্তি। আগে এই শক্তির কড়াল গ্রাস থেকে দেশের ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতির এক গৌরবোজ্জল ইতিহাস রয়েছে। এই ইতিহাস থেকে বর্তমান ছাত্রসমাজকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে কলুসমুক্ত করে এগিয়ে যেতে হবে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার রাজনীতিতে ছাত্ররাজনীতি নতুন মাত্রা যোগ করে। ছাত্রদের সক্রিয রাজনীতিতে পূর্ণতা পায় বিশ শতকে।

১৯২৮ সালের দিকে কংগ্রেসের উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি নামে ছাত্রদের একটি সংগঠন গঠিত হয়।

১৯৪৭ এ দেশ ভাগে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির সূচনা হয়। বিশেষত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ঘোষণার পর ওই বছর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করা হয়। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন এবং তাতে নেতৃত্ব দেয় ছাত্রদের এ সংগঠনটি। এ জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দেয় ছাত্রসমাজ। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশকে গঠনের লক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একসাথে কাজ করা এবং সৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনেও অগ্রণী ভুমিকা রাখে এই ছাত্রসমাজ।

৫০ থেকে ৭০ দশক এবং ৮০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠনের হয়ে যেসব ছাত্রনেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন ইতিহাস তাদের স্মরণীয় করে রেখেছে এবং তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান মর্যাদা পেয়েছেন। ফলাফল হিসেবে আমরা বলতে পারি, আমাদের বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক মন্ত্রী ও এমপিও রয়েছেন, যারা ছাত্ররাজনীতির সোনালী সময় পার করে তাদের যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত বলতে হয় আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন মানবতার প্রতীক, সহপার্টিসহ অন্যের দুঃখ কষ্টে সবসময় এগিয়ে যাওয়া এবং নিজে কষ্ট করে হলেও পরের উপকারে এগিয়ে যাওয়া।

দেশ স্বাধীন হবার পর যে ছাত্ররাজনীতির হাত ধরে দেশের মানুষের স্বপ্ন পুরন হচ্ছির তা অল্পদিনেই পথ হারিয়ে ফেলে নেতৃত্বে বিভক্তীর কারনে। সেই বিভক্তীর কারনেই ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগে বিভক্তী সৃষ্টি হয়ে তেরি হয় জাসদ ছাত্রলীগ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে সামরিক জান্তার আবির্ভাব ঘটলে উল্টোপথে চলতে থাকে এদেশের সামগ্রিক রাজনীতি।

১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনী থেকে দেশের ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছাত্রদল নামে ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তা বিএনপির অঙ্গদলের স্বীকৃতি দেন। অনুমতি দেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির। তখনই জামাত প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র শিবির।এরপর থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শুরু হয় শিবিরের সাথে অন্যদের সংঘর্ষ। চলে নৈরজ্য অরাজকতা। আশির দশকটা সারা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ চলতে থাকে। দিনের পর দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে।

আশির দশকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বিনা রক্তপাতে দেশের ক্ষমতা দখল করেন আরেক সামরিক জান্তা হুসেইইন মোহাম্মদ এরশাদ। নব্য সৈরাচারের উত্থান হয় স্বাধীন দেশে। ঠিক সেই সময় আমাদের দেশের পথ হারানো ছাত্ররাজনীতি আবার সংগঠিত হতে থাকে সৈরশাসনের বিরুদ্ধে। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের মাধ্যমে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে দেশের ছাতসমাজ। তখন মনে হয় আমাদের দেশের ছাত্র সমাজ তাদের আদর্শ ফিরে পেয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদের পতন ঘটিয়ে তবেই ছাত্রসমাজ শান্ত হয়। শুরু হয় দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথচলা।

এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতন্ত্রের নতুন পথচলায় দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেছিলো দেশের শাসন ব্যবস্থা এবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আর কোন সৈরাচার মাথাচারা দিয়ে দাড়াতে পারবেনা। আমাদের ছাত্রসমাজ তাদের অতীত ঐতিহ্য এবং আদর্শ ধরে রেখে সবসময় সুস্থ ধারার রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলবে এবং আরো অনেক শেখ মুজিব, আব্দুল হামিদ শেখ হাসিনা তৈরি হবে। ছাত্র জীবনে শোনা সেই হৃদয় ছুয়ে যাওয়া শ্লোগান ” এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজব ঘরে ঘরে” বাস্তবে রুপ নেবে আমাদের ছাত্র সমাজের মাধ্যমে।

অবস্থাটা ঠিক উল্টো হল। ছাত্রসমাজের সফলতাকে কাজে লাগিয়ে যাদের দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা ঠিক তারাই রাজনীতির অন্তরালে ছাত্রদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। নিজেদের ক্ষমতা পাকা পুক্ত করতে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রনের কথা মনে পোষন করতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ছাত্রনেতাদের মদদ দিতে থাকেন। শুরু হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র সংগঠন গুলোর মধ্যে দ্বন্দ সংঘাত। মেধাবিরা মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে ছাত্ররাজনীতি থেকে।

আমাদের ছাত্রজীবনের সময় সম্পর্কে কিছু কথা বলতেই হয়। ইতিহাস এবং বয়োজষ্টদের মুখে শুনেছি ক্লাশের মেধাবি এবং নিয়মিত ছাত্ররাই সাধারণত রাজনীতিতে আসত। তারা সাধারণ ছাত্রদের সাথে মিশে তাদের সুখ দুঃখের ভাগিদার হত। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে তারা সবসময় কাজ করত। এতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের ছাত্ররাজনীতিতে এক সৌহার্দপুর্ণ পরিবেশ বিরাজ করত। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতার দ্বন্দে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখার জন্যই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ সংঘাত বাধে। খুন, ধর্ষণ, চাদাবাজি, টেন্ডারবাজির মত অপরাধে জড়ানোর অভিযোগও প্রমানিত হয়ে যায় আমাদের ছাত্রসমাজের বিরুদ্ধে। যার সর্বশেষ শিকার বুয়েটের মেধাবি ছাত্র আবরার ফাহাদ। স্বাধীন মত প্রকাশের অপরাধে আবরারকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করে অনুপ্রবেশকারী ছাত্রলীগ নেতারা।

আর এসব কারনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্ররাজনীতির এই দুরবস্থার জন্য দেশে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিভিন্ন মহলের এই দাবিকে যেমন অগ্রাজ্য করা যায়না তেমনি এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন বক্তব্যও থাকতে পারে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করে যদি দেশের বৃহত স্বার্থের কথা চিন্তা করে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এতে করে গৌরবোজ্জল সেই আদর্শের পথ ধরে আমাদের ছাত্ররাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

১. আমাদের ছাত্রনেতাদের নৈতিক অবক্ষয় রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আর এখানে মুল ভুমিকা রাখতে হবে অভিভাবক সংগঠনগুলোকে।

২. ৯০ সালের পর থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাত্রনেতারা একরকম বেকার হয়ে পড়ে। নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ সচল থাকলে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে ছাত্রনেতারা কাজ করতে পারবে। এতে ছাত্রনেতা এবং সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সৌহার্দপুর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। তবে এতে অভিভাবক সংগঠনগুলোকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৩. কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠনগুলোকে বিবেচনা করা যাবেনা এবং নিজেদের স্বার্থে কোন ছাত্রনেতাকে ব্যবহার করা যাবেনা। অর্থাৎ লেজুরবৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহনে দেশের সকল রাজতৈতিক দলকে মতৈক্যে পৌছাতে হবে।

৪. ছাত্রনেতারা যাতে উপার্জনের উদ্ধেশ্যে ঠিকাদারী ব্যবসায় যুক্ত হতে না পারে সেদিকে তাদের মানষিকতার পরিবর্তন করতে সকলকে কাজ করতে হবে। কারন টিকাদারী ব্যবসার উদ্ধেশ্যে ছাত্রনেতাদের টেন্ডার ড্রব করা নিয়ে সৃষ্ঠি হয় দ্বন্দ সংঘাত।
৫. ছাত্ররাজনীতির বয়সসীমা নির্ধারন এবং তা বাস্তবায়নে সকল রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এটা বাস্তবায় করেছে। অন্য সব দলকেও এটি বাস্তবায়নে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

৬. ছাত্রসংগঠগ্রলো নিজেরে স্বার্থসংশ্লিষ্ঠ কোন বিষয়ে যাতে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ীয়ে না পড়ে সেদিকে সরকার এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাজ করতে হবে।

৭. দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক,কর্মকর্তা, কর্মচারীরা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারবেনা। কারন তারা রাজনীতিতে যুক্ত থাকলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া সম্পর্কে নিরপেক্ষ ভুমিকা রাখতে পারবেননা।

আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জল ইতিহাস ভুলে গিয়ে আদর্শ বিচ্যুত হয়ে বর্তমান ছাতসমাজ পথ হারিয়ে ফেলেছে। বিভিন্ন দ্বন্দ, সংঘাত এবং অপরাধমুলক কর্মকান্ডে জড়ীয়ে আমাদের ছাতরাজনীতি এখন কুলসিত হয়েে পড়েছে। যে কারনে মেধাবিরা এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পচনের কারনে অঙ্গ কর্তন না করে পচন ঠেকাতে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহনই শ্রেয়। তাই বলা যায়, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয় বরং এর অতীত ্ঐতিহ্য এবং গৌরবোজ্জল ইতিহাস নতুন প্রজন্মের ছাত্র সমাজের সমানে তুলে ধরে তাদের মানষিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনতে সকল রাজনৈতিক দল এবং সর্বস্তরের মানুষকে ভুমিকা রাখতে হবে।