টাঙ্গাইলে ৪শ' বছরের পুরনো ঐতিহাসিক দুই মসজিদ 

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৫ পিএম, রোববার, ১৭ অক্টোবর ২০২১ | ১৪১৯

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই নতুন বা পুরনো অনেক মসজিদ চোখে পড়ে। এসব মসজিদকে জড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এবং কালিহাতী উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৪শ' বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নান্দনিক দুই মসজিদের ইতিহাস । একটি হচ্ছে দেলদুয়ার উপজেলার লৌহজং নদীর পূর্ব পাড়ে আতিয়া গ্রামে সোয়া ৪শ' বছরের প্রাচীন ইসলামী স্থাপনা আতিয়া মসজিদ। আরেকটি হচ্ছে কালিহাতী উপজেলার পাছ চারান গ্রামে ঐতিহ্যবাহী প্রায় ৪শ' বছরের পুরনো দৃষ্টিনন্দন রাজবাড়ি জামে মসজিদ। এর অবস্থান কালিহাতী বল্লা সড়কের দক্ষিণে ঐতিহাসিক চারান বিলের উত্তরে।

এ মসজিদটি অতি সুপ্রাচীন নান্দনিক ইসলামী স্থাপনা। বিশিষ্ট সুফি সাধক শাহ্ কাশ্মীরীর পরামর্শে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয় ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগনার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এ সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। আর তিনিই আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। 

টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত মূল শিলা লিপিগুলোর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ এলাকায় প্রাপ্ত একটি আরবি এবং একটি ফার্সি শিলা লিপি রয়েছে তবে এগুলোতে মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কিত তথ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত শিলালিপিটিতে নির্মাণকাল ১০১৯ হিজরী (১৬১০-১১ খ্রি.) দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের উপর স্থাপিত অপর শিলালিপিতে এর নির্মাণকাল ১০১৮ হিজরী (১৬০৮-৯ খ্রি.) উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ স্থাপনার তত্ত্বাবধান করছে।

সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতিতে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনায় ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরানী এবং ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি এ মসজিদ সংস্কার করেন।

এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির সামনের দিকে বারান্দার ওপর অপেক্ষাকৃত ছোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। বারান্দাসহ মসজিদটি আয়তন হলো ১৭.৭০ মিটার এবং ১২ মিটার। মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব হলো ২.২২ মিটার। মসজিদের চারকোনে অষ্টকোনী ৪টি মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে ওঠে ছোট গম্বুজে শেষ হয়েছে। পশ্চিম পাশের দেয়ালের অর্থাৎ কিবলা দেয়ালের মধ্যে তিনটি অলংকৃত মেহরাব আছে।

পূর্ব দিকে খিলান বিশিষ্ট তিনটি প্রবেশ পথ। বারান্দা থেকে তিনটি প্রবেশ পথের মাধ্যমে মূল মসিজদে প্রবেশ করা যায়। মসজিদের সম্মুখে অংশসহ পুরো মসজিদেই পোড়ামাটির টেরাকোটা নকশায় অলংকৃত। যে নকশা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া এবং যথাযথ পরিচর্যার অভাবে অনেকটাই বিলুপ্তি পথে।

বাংলাদেশে সুলতানি ও মোগল আমলের যে সব প্রাচীন মুসলিম স্থাপনা রয়েছে, তন্মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপক পরিচিত স্থাপনা। এক সময় বাংলাদেশের ১০ টাকার নোটে এ মসজিদের ছবি স্থান পেয়েছিল। বর্তমান সময়ে এ মসজিদের মতো ইসলামি স্থাপনা দেশে বিরল। বর্তমানে মসজিদটির সংস্কার খুবই জরুরি। 

রাজবাড়ি জামে মসজিদটি কত সালে নির্মাণ করা হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য আজও মেলেনি। আঠার শতকের শেষের দিকে ইসলাম ধর্ম রক্ষার্থে শত্রুদের মোকাবিলা করতে প্রচুর মুসল্লিদের সমাগম হয় কালিহাতির পাছ চারান গ্রাম ও এর আশপাশের স্থানে। ধারণা করা হয় ওই সময়ে যারা এখানে আশ্রয় বা অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের দ্বারাই নির্মিত হয় এই মসজিদটি। এমনও ধারণা করা হয় মসজিদটি মুগলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে। এলাকার প্রবীণরাও তাদের পূর্বপুরুষের কাছে এটি নির্মাণের সঠিক সাল বা বছর জানতে পারেননি।

জমিদারি আমলে রাহাতুন্নিসা চোধুরাণী ছিলেন ওই এলাকার জমিদার। দেলদুয়ার জমিদারদের বংশধর ছিলেন তিনি। জমিদার বাড়ি ছিল মসজিদের উত্তর পাশে। জমিদার প্রথা শেষ হলে ১৯৬২ সালে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে দুই একর ৬৭ শতাংশ জমি পত্তন আনা হয়। যার মধ্যে ছিল ওই মসজিদটিও। পরবর্তীতে মসজিদের ১৪ শতাংশ এবং তার সামনের ৫৩ শতাংশ মাঠ মসজিদে ওয়াকফ করে দেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। ওই সময় মসজিদটির বয়স দেখানো হয়েছিল পৌনে ৪শ' বছর।

মসজিদটির সঠিক বয়স নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রাচীনতম ও ঐতিহ্য হিসেবে এটি টাঙ্গাইলের যে গর্ব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর কারুকার্য খুবই নিপুণ। এর আছে একটি মাত্র গম্বুজ। এজন্য এটিকে এক গম্বুজ মজসিদও বলা হয়। এর মূল স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছে চারটি খুঁটির ওপর। লাগানো হয়েছে চুন-সুরকি। মসজিদটি প্রায় বর্গাকার। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ হাত এবং প্রস্থ প্রায় সাড়ে ১০ হাত। প্রতিটি দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় তিন হাত। মূল স্থাপনার মেঝে আবৃত মার্বেল পাথর দ্বারা।

জানা যায়, স্যার আবদুল করীম গজনবী জীবনের শেষ প্রান্তে যখন ধর্মে-কর্মে মনোযোগী হন তখন তিনি মসজিদটির মেঝে আবৃত করে দেন পাথর দিয়ে। অনেক লতাপাতা খচিত কারুকার্য রয়েছে খিলানের ওপরের দেয়ালে। এগুলো দৃষ্টিনন্দন বলে সবার নজর কাড়ে। বর্তমানে মসজিদটির রয়েছে দু'টি দরজা। উত্তরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় ১৯৯০ সালে সংস্কারের সময়। পাশাপাশি একটি কক্ষও বানানো হয় ইমাম সাহেবের জন্য। এর সর্বশেষ সংস্কার কাজ চলে ২০১৮ সালে। তখন ছাদওয়ালা একটি বারান্দা করা হয় মসজিদটির সামনে।