বিশ্বের কনিষ্ঠতম হেডমাস্টার বাবর

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৫৫ পিএম, সোমবার, ৮ অক্টোবর ২০১৮ | ২৪৫

বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার পথে রোজ সমবয়সী ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে কষ্ট হত ওর। ওরা রাস্তায় পড়ে থাকা জিনিস কুড়োত তখন, কেউ আবার বিড়িও বানাতো। ছেলেটা ভাবত কেন ওরা পড়ার সুযোগ পায় না? যদি ওদের জন্য কিছু করা যেত! বাবর আলি তখন দশ। পঞ্চম শ্রেণী। সেই শুরু, ইচ্ছে থাকলে উপায়ের যে অভাব হয় না ইতিহাস তার সাক্ষী থেকেছে বহুবার।

কলকাতা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার একটি স্কুলের ছাত্র বাবর। সকালে নিজে পড়ে আর বিকেলে অন্যদের পড়ায়। নিজের বাড়ির এক চিলতে উঠোনই তার ইস্কুলবাড়ি। শিক্ষা যেন অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল না হয় সেই লক্ষ্যেই তার এই উদ্যোগ। প্রায় ১৬ বছর ধরে এভাবেই নিজের শেখা অন্যদের শিখিয়ে এসেছে বাবর।

বাবর জানিয়েছে,’আমি যখন স্কুলে যেতাম তখন ওরা আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস খোঁজার চেষ্টা করত। আমি সেটা সহ্য করতে পারতাম না। তাই আমি ওদের আমার বাড়িতে আসতে বলি, যাতে ওদের লিখতে ও পড়তে শেখাতে পারি। আমার বাড়ির উঠোনেই একটা স্কুল গড়ে ওঠে’।

ওই উঠোনটাই ২০০২ সালে হয়ে যায় আনন্দ শিক্ষা নিকেতন। আর বাবর শুধু সেখানকার নয়, গোটা বিশ্বের কনিষ্ঠতম হেডমাস্টারে পরিণত হয়। সকালে ওই ছেলেমেয়ে গুলো নিজের কাজ শেষ করে ফেলত খুব তাড়াতাড়ি কারণ বিকেলে যে স্কুলে যেতে হবে। বাবরের স্কুল শুরু হয় মাত্র আট জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তাদের সঙ্গে ছিল তার নিজের বোনও। পাঁচ বছরের আমিনা খাতুন। বিকেল বেলা প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে নিজের বাড়ির উঠোনে পেয়ারা গাছের তলায় ওই ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাতো বাবর।

মুর্শিদাবাদের প্রায় আট মিলিয়ন জনবসতির একটা বড় অংশই জীবনধারণের স্বার্থে ছোটবেলা থেকেই বাড়ির বড়দের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে বাধ্য হয়। বাবরের বাবা-মা’ও পড়াশুনো শেষ করেননি। কিন্তু ছেলের এই উদ্যোগে পাশে আছেন মা-বাবা। বাবরের মা বানুয়ারা বিবি পেশায় একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। বাবা জুট ব্যবসায়ী। দু’জনই স্কুলছুট। তবে ছেলে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিয়ে মা-বাবা’র গর্বের অন্ত নেই। একটা শিক্ষিত সমাজ গড়তে লড়ছে বাবর। নিয়ম করে গণিত, বিজ্ঞান,ভুগোল পড়াচ্ছে ওদের। আর শেখাচ্ছে ঝরঝরে বাংলায় লিখতে। মাঝে মাঝেই ক্লাস থেকে চক চুরি হত। শিক্ষকরা ধরেও ফেলেন এটা বাবরেরই কাজ। কিন্তু তাঁরা যখন জানতে পারেন কেন বাবর চক চুরি করে? প্রতি সপ্তাহে এক প্যাকেট করে চক স্কুলের মাস্টারমশাইরা বাবরের হাতে তুলে দিতেন।

পরিবার ও স্কুলের চেষ্টায় সেই শিশুদের স্কুলের পোশাক,বই,আরও অন্যান্য পড়ার সামগ্রী দেয় বাবর। এই ধরণের শিশুর পরিবারের লোকজনেদের বোঝাতে সমর্থ হয় বাবর। তারাও স্কুলে পাঠাতে রাজি হন বাচ্চাদের।

২০১৫ সালে উঠোন থেকে একটা বাড়িতে স্থানান্তরিত হয় বাবরের স্কুল। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে একটি বেসরকারি স্কুল হিসেবে স্বীকৃতিও পায় স্কুলটি।

গত ১৬ বছরে প্রায় ৫০০০ জন শিশুকে শিক্ষিত করেছে বাবর। বেশ কয়েকজন আবার সেই স্কুলেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। ২৫ বছর বয়সী বাবর নিজে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছে। এখন ইতিহাসে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশুনো করছে সে। বাবর তার জেলার দরিদ্রমানুষদের শিক্ষার হারে পরিবর্তন আনতে চায়।

নিজের স্কুল নিয়ে তার এখন বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বামী বিবেকান্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত বাবর একজন মোটিভেশনাল স্পিকার। বাবরের কথায়,’সরকার একা নিয়ম বদলাতে পারবে না। সকলকে এগিয়ে আসতে হবে’।