বিদেশী যন্ত্রাংশের দাপটে বিলুপ্তির পথে ঢুলি সম্প্রদায়

স্টার্ফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: ০৪:০১ পিএম, সোমবার, ১ মার্চ ২০২১ | ৫০৪

বাংলা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ঢুলি সম্প্রদায়। এ সংস্কৃতির ঐতিহ্যে বিকাশেও রয়েছে এ সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলা সংস্কৃতির যাত্রা, নাটক, বাউলগান, পালাগান হয়েছে এ সম্প্রদায়ের হাত ধরে সমৃদ্ধ। এ সম্প্রদায়ের উর্বর ভূমি টাঙ্গাইল জেলা। যার নিদর্শন এখনও ধরে রেখেছে জেলার ঘাটাইল উপজেলার দিগর ইউনিয়নের হামিদপুরের বায়ানপাড়ায় বসবাসরত ঢুলি সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবার।

তবে আধুনিক যন্ত্রাংশের দাপটে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে এ সম্প্রদায়ের কার্যক্রম। এর ফলে চরম অভাব অনটনে কাটছে এ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা। পেটের দায়ে সম্প্রদায়ের কেউ কেউ বেঁছে নিচ্ছেন অন্য পেশা। ঝুঁপড়ির ঘর, উন্মুক্ত পায়খানায় এ সম্প্রদায়ের শিশুসহ পরিবার গুলো যেমন রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে, তেমনি রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা প্রদ্ধতি সম্পর্কে অসচেতনতা। গ্রামটিতে রয়েছে চরম পয়ঃনিস্কাশন সমস্যাও। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেও দিনদিন বাড়ছে এ গ্রামে বসবাসরত পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা।

জানা যায়, প্রায় ৩’শ বছর যাবৎ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দিগর ইউনিয়নের হামিদপুরের বায়ানপাড়ায় বসবাস করে আসছে ঢুলি সম্প্রদায়ের এ পরিবার গুলো। ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের গ্রাম এই বায়ানপাড়া বা নার্গাচিপাড়া। ব্যক্তি মালিকাধীন ৫৯ শতাংশ জমির উপর অবস্থিত এ গ্রামটিতে বসবাসরত পরিবারের সংখ্যা শতাধিক হলেও এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২’শ জন। তাদের ভোটার সংখ্যা ১০৫জন।

এছাড়াও ইসলাম ধর্মাবলম্বী এ সম্প্রদায়ের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন এই বাদ্যযন্ত্র। পরিবারের উপার্জনক্ষম শিশু থেকে বৃদ্ধ একজন হলেও রয়েছে এ পেশায় জড়িত। গ্রামটিতে বর্তমানে এ পেশার কাজ করছে লিপ্ত রয়েছেন বাসন্তী ব্যান্ড পার্টি, মনির ব্যান্ড পার্টি, বাংলাদেশ ভান্ডারী ব্যান্ড পার্টি, স্বপন ব্যান্ড পার্টি, শাহিন ব্যান্ড পার্টি, ফখর উদ্দিন ভাই ভাই ব্যান্ড পার্টি, সুমাইয়া ব্যান্ড পার্টি, বৃষ্টি ব্যান্ড পার্টি ও হৃদয়-রিপন ব্যান্ড পার্টির মত কয়েকটি দল। এক একটি দলে কাজ করছে কমপক্ষে ১২জন সদস্য। বাংলা বছরের বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ন, মাঘ আর ফাল্গুন এ সম্প্রদায়ের উপার্জনের সময়।

এ সকল ব্যান্ড পার্টির একটি দলে কাজ করেন ৬জন বাঁশি বাদক, ১জন বাংলা সানাই বাদক, ১ জন জয় ঢাঁক বাদক, ১জন ঢোল বাদক, ১জন জুড়ি বাদক, ১ জন কারা বা ছোট জয় ঢাঁক বাদক আর ১জন করতাল বাদক। নাটক, যাত্রা, বাউলগান, পালাগান, হিন্দু বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পূঁজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওরশ, র‌্যালীসহ নানা ধরণের সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় তাদের বাদ্যযন্ত্র। এ ধরণের প্রতিটি দিনব্যাপি অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বাবদ জনপ্রতি পান এক হাজার টাকা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্যক্তি মালিকাধীন মাত্র ৫৯ শতাংশ জমিতে অবস্থিত এ গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে মাত্র একটি সেমিপাকা ঘর। বাকি সব ঘরগুলোই তোলা হয়েছে টিনের ঝুঁপড়ি দিয়ে। ৫৯ শতাংশ জমির গ্রামটিতে এতগুলো পরিবার বসবাসের ফলে তাদের এক একটি পরিবার এক বা আধা শতাংশ জমির মালিক। আবার অনেকেই আছেন ভূমিহীন। নেই তাদের কোন আবাদী জমি। এদের বেশিরভাগ ঘরেই নেই শোবার মত খাট বা চৌকি। সরকারিভাবে স্যানেটারী পায়খানা তৈরির রিং পাট আর স্লাব বসানো হলেও সেগুলোতে টিনের বেড়া দেয়ার সাধ্যও হয়নি হতদরিদ্র এই পরিবারগুলোর। এ কারণে পলিথিন বা সিমেন্টের কাগজ দিয়ে ঘিরেই কোন রকমে চলছে এর ব্যবহার। এর মধ্যেই চলছে গ্রামটিতে বসবাসরত শিশুদের খেলাধুলা, বৃদ্ধসহ পরিবারের সকল বয়সী নারী পুরুষের চলাচল। একই সাথে পরিবার পরিকল্পনা প্রদ্ধতি মেনে চলার চরম অসচেতনতায় গ্রামটির প্রতিটি পরিবারেই বৃদ্ধি পেয়েছে সদস্য সংখ্যা। এছাড়াও ওই গ্রামের মরহুম বরকত আলী নার্গাচীর স্ত্রী খুশিরন (৫৫) প্রধানমন্ত্রীর দেয়া একটি ঘর পেলেও তারও নেই স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানার ব্যবস্থা।

বায়ানপাড়া গ্রামের চার সন্তানের জনক ও বয়োজ্যেষ্ঠ করনেট বাঁশি বাদক দরাজ আলী নার্গাচী (৭৮) জানান, আমাগো জাতিগত ব্যবসা এই ঢোল ব্যবসা। পূর্বপুরুষ থেকে আমাগো এই ব্যবসা চৈইলা আসছে। ব্যবসা বাণিজ্য নাই, তাই খুব অভাবে আছি। বছরের ছয় মাস চলে আমাগো এই ব্যবসা। যখন কাম থাকেনা তহন আমরা রিক্সা বাই, কেউ কেউ আবার হাটে বাজারে ইঁদুর, তেলাপোকা, পিঁপড়া মারার ওষুধ বিক্রি কৈইরা চলে।

চার সন্তানের জনক ও বাঁশি বাদক জোয়াদ আলী নার্গাচী (৪৮), দুই সন্তানের জনক ও বাঁশি বাদক শফিকুল ইসলাম নার্গাচী (৩৪) ও তিন সন্তানের জনক আহাম্মদ আলী ভান্ডারী নার্গাচী (৫০) বলেন, অন্য কোন কাম জানা নাই বৈইলা কোন রকমে এ পেশা দিয়াই বাইচা আছি। আমরা নাটক, যাত্রা, বাউলগান, হিন্দু বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পূঁজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওরশ, র‌্যালীসহ বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে থাকেন তার। তবে দেশে এখন বিদেশী বাদ্যযন্ত্র আইসা পড়ায় আমাগো চাহিদা কৈইমা গেছে। এ কাম কৈইরা এখন কোন রকমে চলতাছে আমাগো পেট। বাংলার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন তারা।

চার সন্তানের জনক হযরত আলী নার্গাচী (৫৫) বলেন, আমাগো পূর্বপুরুষের ব্যবসা এই ব্যান্ডপার্টি। এ ব্যবসার উপরই আমাগো সংসার চলতাছে। এখন ডিজিটাল সব যন্ত্রপাতি আইসা পড়ায় আমাগো ব্যবসা কৈইমা গেছে। এ ব্যবসা ছাড়া আমাগো কোন অর্থ সম্পদ নাই। বছরের ছয়মাস যখন কাম না থাকে পেটে ভাতে বেঁচে থাকার তাগিদে দিনমজুরের কাম করাসহ রিক্সা চালান বলেও জানায় সে।

আপন ঢুলি নার্গাচী (২৮) বলেন, আমরা খুবই দরিদ্র এ কারণে ছালা দিয়া ঘিরা পায়খানা ব্যবহার করতাছি। সরকারিভাবে দেয়া পায়খানা আমরা গরীব বৈইলা পাইনা। অন্যজনাগো দিয়া দেয়। চেয়ারম্যান-মেম্বাররে জানাইয়া কোন কাম হয়নাই বলেও জানান তিনি।

ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড ও বায়ানপাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, প্রায় তিন’শ বছর যাবৎ এ গ্রামে এই বায়ান সম্প্রদায়ের বসবাস। আধুনিক সব প্রযুক্তি আসায় এ ব্যবসায় প্রায় ধস নেমে গেছে। ব্যবসা খারাপ হওয়ায় এ পরিবারগুলোর অনেকেই এখন হাটে বাজারে মশা, মাছি ও ইঁদুরের ওষুধ বিক্রি কৈইরা পেট চালাইতাছে। এ গ্রামে বসবাসরত পরিবারগুলোর অধিকাংশেরই কারো আদা শতাংশ জমি, কারো এক পোয়া শতাংশ জমি, কারো তিন পোয়া শতাংশ জমি, কারো এক শতাংশ জমি রয়েছে। আবার অনেকেই আছেন একদম ভূমিহীন।

তিনি আরো জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পায়খানা নির্মাণ বাবদ তাদের বেশিরভাগ পরিবারকে রিং পাট ও স্লাব দেয়া হয়েছে। পায়খানা নির্মাণে কোন টিনের বেড়া দেয়ার বরাদ্দ নেই। তবে যদি দেয়ার মত কোন সুযোগ তিনি পান অবশ্যয় এই পরিবারগুলো সেই সুযোগ ভোগ করবেন।

দিগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ (মামুন) বলেন, বায়ানপাড়ার অধিকাংশ পরিবারকে পায়খানা নির্মাণে রিং পাট ও স্লাব দিয়েছেন তারা। বেড়া তাদের দিয়ে নেয়ার কথা। এছাড়াও প্রতি বছরই বন্যায় ওই গ্রামটি তলিয়ে যেত বলে ইতিপূর্বে বাঁশের সাঁকো দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা করে দিয়েছিল তারা। পরবর্তীতে মাটি ফেলে বায়ানপাড়ায় যাতায়াতের রাস্তাও করে দেয়া হয়েছিল। তবে বন্যায় ওই রাস্তাটির অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে। এরপরও এলজিএসপির বরাদ্দ থেকে গ্রামটির রাস্তা রক্ষায় গাইডওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করেছি।

এছাড়াও গ্রামটির পানি নিস্কাশনের জন্য প্রায় দশ বিঘা জমির নিচ দিয়ে পাইপ বসিয়ে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে সেটি কিছুদিন পানি চলাচল করার ফলে ও ময়লা ঢুকে বন্ধ হয়ে গেছে। পুনরায় সেটি সংস্কারের চিন্তা ভাবনা করতেছি।

তিনি জানান, পায়খানা নির্মাণে সরকারিভাবে দেয়া রিং পাট ও স্লাব দেয়ার পরও যদি কেউ বেড়া দিতে না পেরে থাকেন তাহলে তিনি তাদের ব্যক্তি উদ্যোগে পায়খানার বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে বিনামূল্যে ঘর ও পায়খানা নির্মাণ করে দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে আসা ওই প্রকল্পের কাজে কেন বায়ানপাড়ার খুশিরন (৫৫) নামের বিধবা ওই নারীকে টিনের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হলেও পায়খানা নির্মাণ করা হয়নি বিষয়টি দেখবেন তিনি।

তিনি আরো জানান, এ প্রকল্পে উপজেলায় যে কয়টি ঘর দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে ১৬-১৭জন পায়খানা আছে তাই পায়খানা নিবেন বলে লিখিত দেন। এ কারণে তাদের ওই পায়খানা নির্মাণ ব্যয়টি সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য রাখা হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. সাইফুর রহমান খান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা প্রদ্ধতি মেনে চলার বিষয়টি দেখেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আর স্যানিটেশনের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের।

তিনি জানান, এ ধরণের সমস্যায় শুধু ওই গ্রামের শিশুরাই নয়, আশপাশের বিভিন্ন বয়সীরাই স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পরতে পারে। নিশ্চয় দায়িত্বরত বিভাগগুলো বিষয়গুলো দায়িত্বের সাথে দেখবেন।

এছাড়াও ওই ইউনিয়নে স্বাস্থ্য বিভাগের কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তিনি ওই গ্রামের শিশুরা ঠিক মত ভ্যাকসিন পাচ্ছে কিনা সে বিষয়টি দেখাসহ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশ দিবেন বলেও জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অঞ্জন কুমার সরকার জানান, সমাজ সেবা কর্মকর্তাকে নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যেই ঢুলি সম্প্রদায়ের বসবাসরত বায়নপাড়া গ্রামটি পরিদর্শন করা হবে। তাদের কি দরকার সেটি নির্ণয় করাসহ স্যানিটেশন সমস্যা সমাধান এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সাধ্য মত সহযোগিতা করারও উদ্যোগ রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টুনির আওতায় আসা বিভিন্ন প্রকল্পে তাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথাও জানান তিনি।