দুদকের সাবেক ডিডিকে গ্রেফতারের দাবি, বন্দর অচল করার হুমকী

মোঃ সাগর হোসেন, যশোর
প্রকাশিত: ০৪:৫১ পিএম, বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০১৯ | ৪৪০

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর সাবেক ডিডি আহসান আলীকে আবারো গ্রেফতারের দাবী জানিয়েছে বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারী ৭ সংগঠন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাকে গ্রেফতার করার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। নির্ধারিত সময়ে আহসান আলীকে গ্রেফতার করা না হলে সারা দেশে ব্যবসায়ী সংগঠন গুলো কঠোর কর্মসূচী ঘোষনা করবে বলেও জানানো হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। আর এতে করে জাতীয় রাজস্ব আহরণ কর্মকান্ডে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশংকা করছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।

বেনাপোল কাস্টমস’র সহকারী কমিশনার উওম চাকমা জানান, দুর্নীতিবাজ, তদবিরবাজ ও ভায়াগ্রা চোরাচালানের গডফাদার সাবেক ডিডি আহসান আলী কাস্টম হাউসের নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্য বেনাপোল কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের দীর্ঘদিন থেকে দুদক দিয়ে হেনস্থা করার ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছেন। তাঁর নিজের বিনিয়োগকৃত ও তদবিরকৃত প্রতিষ্ঠান রিতু ইন্টারন্যাশনাল ও জেড. এইচ কর্পোরেশনের ৩১ টি চালানে ২ কোটি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার শুল্কফাঁকি ধরা পড়ে। পরিকল্পিত শুল্কফাঁকি ও ২০১৯ সালের গত জুলাই মাসে ২.৫ মে.টন ভায়াগ্রা খালাসে ব্যর্থ হয়ে কমিশনারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হন আহসান আলী। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে তাঁর ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ডের ফলে কর্মকর্তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেনি।

বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে পণ্য আটক ও লাগাতার হয়রানির কারণে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরাও ভয়ে স্বাভাবিক আমদানি করেনি। ফলে ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৫১৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয় সরকারের। দীর্ঘ সময়ে মোবাইলে আহসান আলীর ০১৭৭০২৯৪১০৪ ও ০১৯১৮৫৩১৬৮০ নম্বর থেকে ফোনকল ও এসএমএস এর মাধ্যমে কমিশনারকে হুমকি দেয়া হয়। গত ১৯ নভেম্বর আহসান আলী সশরীরে কমিশনারের দপ্তরে এসে কমিশনারকে ২০ লক্ষ টাকা ফাঁকির সুযোগ চেয়ে তদবির, দেনদরবার ও চাপ সৃষ্টি করেন, এ সময় সহকারী কমিশনার ও প্রতিষ্ঠানের দশ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

বেনাপোল কাস্টমস হাউসের শুল্ক ও ভ্যাট এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক রাজস্ব কার্মকর্তা বিল্লাল হোসেন জানান, হুমকি ও চাপে কমিশনারকে কাবু করতে না পেরে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এ কমিশনারের বিরুদ্ধে জনৈক এডভোকেট শাহাদাত হোসেন নাম দিয়ে (যার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি) ৪ পাতার একটি মনগড়া ও সাজানো দু’ডজন অভিযোগ সম্বলিত বেনামী লিখে দুদকে জমা দেন এবং তা শতাধিক দপ্তর ও মিডিয়ায় বিতরণ করেন। পত্রটি দুদক আমলে নিয়ে এনবিআরসহ চার জায়গা থেকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়। দুদকের অনুরোধে সম্পাদিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তে একটি অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। আহসান আলী সিএন্ডএফ এজেন্ট জনৈক কামরুল নাম দিয়ে মনগড়া তথ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকটি বেনামী দৃদকে জমা দেয় এবং এটিও আমলে গৃহীত হয় এবং অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়া হয়; দুদকে অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণের বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে গত ৫ আগস্ট বিভিন্ন টিভির স্ক্রলে ও পত্রিকায় প্রচার করে কমিশনারকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্থা করা হয়।

একইভাবে হেনস্থার উদ্দেশ্যে গত ৯ সেপ্টেম্বর দুদকে কমিশনারের হাজিরার জাল নোটিশ মিথ্যা তথ্য, তারিখ ও সময় উল্লেখপূর্বক পরিকল্পিতভাবে জাল করে আহসান আলী মিডিয়ায় বিতরণ ও প্রচার করে, যা অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অবহিত আছেন। আহসান আলী কেবল হয়রানি, শত্রুতা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থের জন্যে দুদকের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম, পদবী ও ক্ষমতা এবং প্রশাসনসহ দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হন বলে বেনাপোলের ব্যবসায়ী সংগঠন মনে করেন। বেনাপোল কাস্টম হাউসের ৩৫০ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে ৯ মাস বাড়তি কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখেন। ফলে, আতংক ও ভোগান্তি ছাড়াও সামগ্রিক কর্মপরিবেশ বিনষ্ট হয়। সারাদেশের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়মিত কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

দুদক সূত্রে জানা যায়, নানা দুর্নীতি এবং বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে বেনামী অভিযোগ দিয়ে প্রায়ই হয়রানি করতেন দুদকের সাবেক উপ-পরিচালক আহসান আলী। এসব অভিযোগের কারণে ২০১৫ সালে তাকে উপ-পরিচালক হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কখনও তিনি ‘দুদকের হবু ডিজি, কখনও দুদকের চেয়ারম্যানের কাছের লোক, কখনও দুদক পরিচালক’ পরিচয় দিয়ে মানুষজনের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।
সূত্রটি জানায়, দুদকে চাকরিকালে আহসান আলী নিজ সহকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক বেনামী অভিযোগ দাখিল করতেন। তার বিরুদ্ধেও কোনো কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতির অভিযোগ দেন। অভিযোগে আহসান আলীর বিরুদ্ধে নামে-বেনামে কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, আহসান আলী সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে যে আয়কর নথি দাখিল করেছেন প্রতিবার কমিশন সেটিই গ্রহণ করে বিনা বাক্যে দায়মুক্তি দিয়েছে। অন্যদের যে প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান করা হয়-আহসান আলীর ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। ফলে অনুদঘাটিতই থেকে যায় তার সম্পদ-সাম্রাজ্য।

দুদক সূত্রমতে, ২০১৫ সালে আহসান আলীর বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান শুরু হয়। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আহসান আলীর নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল সম্পদ। এর মধ্যে নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার রোড-০৫, বাড়ি নম্বর ৪৭-এ ৩ কাঠা প্লটের ওপর ৩ তলা ভবন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের নথিতে এ বাড়ির তথ্য উল্লেখ করেন। আয়কর নথিতে আহসান আলী এটির দাম দেখিয়েছেন ৯১ লাখ টাকা। কমিশন সেটিই মেনে নিয়েছে। আহসান আলী তার আয়কর নথিতে ১ কোটি ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে বলে দাবি করেন। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ। মোট আয়ের উৎস মিলেছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৭৭,১৫০ টাকা। কমিশন বিনা প্রশ্নে সেটিই মেনে নেয়।

দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীর তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ভূমি অফিস থেকে রেকর্ডপত্র চাওয়া হয় - আহসান আলীর জন্যে তেমন তথ্য চাওয়া হয়নি। অন্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যেভাবে তলবি নোটিশ দেয়া হয়, সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হয় আহসান আলীর ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। ফলে অনেকটা গোপনেই একাধিকবার দায়মুক্তি দেয়া হয় তাকে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে তাকে দায়মুক্তি প্রদানের সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন পরিচালক জানান, আহসান আলীকে নিয়ে দুদক বিব্রত। প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্য ও সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জাতিসংঘের এসডিজি এজেন্ডার ১৭.২ অনুযায়ী ‘রাজস্ব’ যেকোন দেশের অগ্রাধিকার।এভাবে সাজানো বেনামী দিয়ে অহেতুক হয়রানিতে রাজস্ব আদায়ের জরুরী কাজ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়।

বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ্ব নুরুজ্জামান জানান, রাজস্ব আদায়ে সংশ্লিষ্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও কর্মকর্তা কর্মচারী, আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের হয়রানি বন্ধে আহসান আলীকে অনতিবলম্বে গ্রেফতারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া একান্ত জরুরী বলে ব্যবসায়ী মহল মনে করছেন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে যদি আহসান আলীকে গ্রেফতার করা না হয় তাহলে সারাদেশে প্রতিটি কাস্টমস হাউসে কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে।