ইয়াসিন কেন খুন হলো?

অালোকিত ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:২০ এএম, সোমবার, ৩১ জুলাই ২০১৭ | ১২৩২
ইয়াসিন সানী১৪ বছরের কিশোর ইয়াসিন সানীকে কেন মরতে হলো, তার পরিবার জানতে চায়। জামিয়াতু বদর আল আরাবিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার এই ছাত্র চার দিন নিখোঁজ ছিল। ২৩ জুলাই একটি জলা থেকে তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, ইয়াসিনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীর খিলক্ষেতের ঢেলনায় বালু নদের পারে জামিয়াতু বদর আল আরাবিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় চার বছর ধরে ইয়াসিন সানী লেখাপড়া করছিল। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ইয়াসিন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে রহস্যজনক আচরণ শুরু করে। থানায় নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি করার পর পুলিশের যে তৎপরতা ছিল, লাশ পাওয়ার পর আর সেই উদ্যোগ দেখা যায়নি। তাঁরা হত্যা মামলা করতে চাইছেন, কিন্তু পুলিশ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না পাওয়া পর্যন্ত হত্যা মামলা নিচ্ছে না। ইয়াসিন সানীর বড় ভাই মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের পুরো শরীরে নির্যাতনের দাগ ছিল। তার পায়ের গোড়ালিতে আঘাত ও পুরুষাঙ্গ ফোলা ছিল। কনুই থেকে হাড়ও বেরিয়ে এসেছিল। গলায় দাগ ছিল এবং পুরো জিব ছিল বাইরে।’ দাবির সমর্থনে শফিকুল ইসলাম বেশ কিছু ছবিও এই প্রতিবেদককে দেখান। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হইছে। তাদের এমন কোনো কর্মকাণ্ড আমার ভাই জেনে ফেলেছিল, যেটা প্রকাশ করলে তাদের বিপদ হওয়ার শঙ্কা ছিল।’ ইয়াসিনের স্বজনেরা জানান, ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইমরান হোসেন ফোন করে শফিকুলকে জানান, ইয়াসিন সানীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পেয়েই শফিকুল তাঁর ভাই মাহমুদুলসহ মাদ্রাসায় আসেন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানায়, ওই দিন বেলা ১১টার দিকে জলা থেকে মাদ্রাসাছাত্রদের দিয়ে বাঁশ ওঠানো হয়েছিল। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সব ছাত্রকে মাদ্রাসার ভেতরে অজুখানায় গোসল করতে পাঠানো হয়। সে সময় একজন শিক্ষক ইয়াসিন সানীকেও গোসলে যেতে বলেন। কিন্তু জোহরের নামাজের পর মাদ্রাসার ছাত্ররা অধ্যক্ষকে জানায়, ইয়াসিন সানীকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়াসিনের স্বজনেরা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে মাইকে তার নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রচারের অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা বলে, এতে মাদ্রাসার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তাঁরা থানায় নিখোঁজ জিডি করতে চাইলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। ওই একই মাদ্রাসায় শফিকুল ও মাহমুদুলের সবচেয়ে ছোট ভাইটি পড়ে। সে কারণে পরিবার ছিল নমনীয়। তবে শেষমেশ ২২ জুলাই খিলক্ষেত থানায় নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করা হয়। পরদিন দুপুরে ফোনে মাহমুদুল হোসেনকে দ্রুত ঢেলনায় যেতে বলা হয়। প্রথমে ঘটনাস্থলে পৌঁছান শফিকুল। শফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মাদ্রাসায় পৌঁছেই দেখি জলার সামনে মানুষের জটলা। একটা মৃতদেহ উপুড় হয়ে ভাসছে। আমি একনজর দেখেই বুঝতে পারি এটাই আমার ভাই। তখন একজন পুলিশ সদস্য মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে বলেন, আপনি যে বলছেন এই লাশটা আপনার ছাত্রের না?’ লাশটা পানি থেকে তোলার পর ইয়াসিনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায় বলে জানান শফিকুল। কিন্তু খিলক্ষেত থানা–পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদনে অনেক তথ্যই এড়িয়ে গেছে বলে তাঁর অভিযোগ। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাদ্রাসার উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা জলা থেকে বাঁশগুলো তুলে ফেলার ‘আবদার’ করে। একদল ছাত্র সাঁতার কেটে রশিতে বাঁধা বাঁশগুলো খুলে তীরে নিয়ে আসে, অন্যরা সেগুলো মাদ্রাসায় নিয়ে যায়। তবে তাদের মধ্যে ইয়াসিন সানী ছিল না। ছাত্ররা বেলা পৌনে ১১টার দিকে বাঁশ তুলতে নামে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই ফিরে আসে। মাদ্রাসার যেসব ছাত্র ওই দিন বাঁশ তুলতে পানিতে নেমেছিল, তারা বলেছে ইয়াসিন তাদের সঙ্গে পানিতে নামেনি। মাদ্রাসাছাত্ররা ইয়াসিনকে পানিতে নামতে দেখেনি, ডাঙায় থাকা অবস্থায় তাকে গোসল করতে যেতে বলা হয়, তাহলে তার লাশ পানিতে এল কোথা থেকে? এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন শিক্ষক সবশেষ ইয়াসিনকে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে দেখেছেন, এ কথা সত্য। ওই শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেও শেষ পর্যন্ত আর কথা বলার সুযোগ দেননি তিনি। তাঁর নামও বলেননি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও অন্য শিক্ষকেরা। ছাত্রের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি কেন—এমন প্রশ্নেরও সদুত্তর পাওয়া যায়নি তাঁর কাছ থেকে। ইয়াসিন সানীর মৃত্যু নির্যাতনের কারণে হয়েছে—পরিবারের এমন দাবি সম্পর্কে ইমরান হোসেন বলেন, মাঝে মাঝে শাসনের জন্য দু–একটা বেত মারা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু করা হয়নি। এখন পর্যন্ত পুলিশ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। মাদ্রাসায় ইয়াসিন সানীর জিনিসপত্রও পুলিশ নিজেদের জিম্মায় নেয়নি। সুরতহাল প্রতিবেদন নিয়েও পরিবারটির অসন্তোষ আছে। পুলিশের খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদুল হক বলেন, শত শত মানুষের সামনে সুরতহাল প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। ইয়াসিন সানীর লাশটিই রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য যথেষ্ট। তাঁরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সেটি হাতে পেলে নিহত ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।