পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সংবাদ অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী শহিদ খাকান আব্বাসি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে শরিফ পরিবারই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৩৮ পিএম, রোববার, ৩০ জুলাই ২০১৭ | ২৩৫

পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দলের মধ্যে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে ছোট ভাই শাহবাজ শরিফকেই উত্তরসূরি করার যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেটাই গতকাল শনিবার দলীয় সভায় চূড়ান্ত হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী শহিদ খাকান আব্বাসির মনোনয়ন ছিল কিছুটা চমকপূর্ণ। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে কয়েকজন বিবেচনায় ছিলেন, তাঁদের বাদ দিয়ে দলের বিশ্বস্ত ও রাজনীতিতে স্বল্পপরিচিত আব্বাসিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ৩৪২ আসনের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নওয়াজের দল পিএমএল-এন এবং তার শরিকদের আসনসংখ্যা ২০৯। ফলে শাহবাজ শরিফই যে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, সেটা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করার ৪৫ দিনের সময়টাতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটা পালন করবেন শহিদ খাকান আব্বাসি। পিএমএল-এন শাহবাজ শরিফকে নিজেদের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মেহমুদ কুরেশি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোতে (এনএবি) যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রক্রিয়াধীন আছে, তাঁকে মনোনীত করে দেশ আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে। উঁচু পদে মনোনীত করার সময় পরিবারের বাইরের কাউকে বেছে নেওয়ার মতো পরিপক্বতা পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের কবে হবে? দলটিতে এত সদস্য আছেন, তাঁর চেয়ে যোগ্য কাউকে কি ওই পদে খুঁজে পাওয়া যায়নি? এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর এক দিন পর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন নওয়াজ শরিফ। মুসলিম লিগের সংসদীয় দলের বৈঠকে নওয়াজ শরিফ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে আমার অযোগ্যতা যে দুর্নীতির জন্য নয়, সে জন্য আমি গর্বিত। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। আমি অন্যায় করে থাকলে নিজেকে অপরাধী ভাবতাম।’ তিনি সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনার ওপর জোর দেন, শুধু একটি পরিবারকে নয়। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ফৌজদারি তদন্তের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা আমলে নিয়ে এনএবি কাজ করার কথা ভাবছে। ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এনএবির চেয়ারম্যান কমর জামান চৌধুরী শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত রায় হাতে পাওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে নওয়াজ শরিফ, ইসহাক দার, মোহাম্মদ সফদার, মরিয়ম নওয়াজ, হাসান ও হোসাইন নওয়াজের বিরুদ্ধে এনএবি মামলার প্রক্রিয়া শুরু করবে। আর ছয় মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা করতে হবে। এদিকে নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের ৪৮ ঘণ্টা পর তাঁর সমর্থকেরা বিক্ষোভ করেছেন। উল্লাস করেছে পিটিআইসহ বিরোধী পক্ষ। তবে কোনো পক্ষই তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সংঘাতে জড়ায়নি। নওয়াজের পদত্যাগে আজ রোববার রাওয়ালপিন্ডি প্যারেড গ্রাউন্ডে আনন্দ সমাবেশ ডেকেছে পিটিআই। ওই সমাবেশে ইমরান খানের দলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক কোনো ঘোষণা আসে কি না, তা নিয়ে লোকজনের কৌতূহল আছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পালাবদল প্রতিবেশী ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নানা সমীকরণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। আর চীনের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে পাকিস্তানে। অন্যদিকে সীমান্তসহ নানা বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। তাদের দুই দেশের রাজনীতির অনেক কিছুর ওপরই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রভাব ফেলে। তবে ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে নওয়াজের পদত্যাগে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। দেশটির গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে রাজনৈতিক শূন্যতা পুঁজি করে সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী হয় কি না, এ নিয়ে জল্পনা আছে। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, নওয়াজের পদত্যাগের ফলে পাকিস্তানে রাজনৈতিক পালাবদল নির্বিঘ্ন হবে। তবে নওয়াজের বিষয়ে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা উইলসন সেন্টারের পরিচালক মাইকেল কুগলম্যান বলেছেন, নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিজয়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু কাং বলেছেন, নওয়াজের পদত্যাগ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে কোনো প্রভাব ফেলবে না। বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে চীনের প্রত্যাশা, পাকিস্তানের সব দল এবং পক্ষ রাষ্ট্র ও দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মোকাবিলায় ঐক্য, স্থিতিশীলতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগী হবে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পাকিস্তানের লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারিক আলী নওয়াজের পদত্যাগের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, কারিগরি কারণে তাঁকে সরে যেতে হয়েছে। ‘সততা ও নিষ্ঠা’—এই দুই যোগ্যতা সম্পর্কে সংবিধানের যে ধারার কারণে নওয়াজ সরতে বাধ্য হলেন, সেটি তাঁর একসময়ের পৃষ্ঠপোষক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার উদ্যোগের ফল। এখন সততা ও নিষ্ঠা—এই দুই যোগ্যতা খুঁজতে গেলে পাকিস্তানের পুরো জাতীয় পরিষদ শূন্য হয়ে পড়বে। শাহবাজ শরিফ কীভাবে নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন ও দুজনের পরিচয় শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতে হবে। নওয়াজ শরিফের শূন্য আসনেই তিনি নির্বাচন করতে পারেন। এর আগে অবশ্য প্রথমে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হবে তাঁকে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদে শাহবাজের উত্তরসূরি হিসেবে পরিবারের বিশ্বস্ত কাউকে বাছাই করাই এখন তাঁদের আরেকটি বড় চ্যলেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক শুল্কমন্ত্রী মুজতবা সুজাউর রহমানকে ভাবা হচ্ছে বলে পাকিস্তানি গণমাধ্যমের খবর। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন শাহবাজ শরিফ। ভাই নওয়াজের মতো সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের না হলেও বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ হিসেবে খ্যাতি আছে শাহবাজের। কাজপাগল হিসেবে পরিচিত পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে খাদিম-ই-আলা (প্রধান সেবক) বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং ইত্তেফাক গ্রুপ অব কোম্পানিজের অন্যতম মালিক। ১৯৯৭ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শুরু করেন। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সেনা অভ্যুত্থানের পর ১৯৯৯ সালে শরিফ ভাইদের সৌদি আরবে নির্বাসনে চলে যেতে হয়। এক দশক পর পিএমএল-এন ২০০৮ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জেতার পর আবার মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন শাহবাজ শরিফ। ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শুধু একবার তিনি ২০০২ সালে নির্বাচনে হেরেছেন।