তথ্যমন্ত্রীর ৫৭ ধারা আর আমাদের ‘হৃৎকম্পন’

অালোকিত ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২৭ পিএম, রোববার, ৩০ জুলাই ২০১৭ | ২৪১
বিল ভরাট করা জায়গার নাম লেকসিটি, সম্পূর্ণ কংক্রিটের ভবনের নাম মাটির মায়া। আর যিনি আমাদের তথ্যমন্ত্রী, তিনি নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারার পক্ষে! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া, শিক্ষামন্ত্রীর কাজ শিক্ষা ছড়ানো। তেমনি তথ্যমন্ত্রীর কাজ হওয়ার কথা তথ্যপ্রবাহ ও মতপ্রকাশের বাধা দূর করা। অথচ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা বহাল রাখার পক্ষে সংগ্রাম করেই যাচ্ছেন। প্রথম আলোর আজকের খবর, ‘গতকাল সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে বিষয়টি সম্পর্কে অনির্ধারিত আলোচনায় তথ্যমন্ত্রী তাঁর এই অবস্থান ব্যক্ত করেন।’ আমাদের তথ্যমন্ত্রী খুবই সংস্কৃতিমনা। কবিতা, গান ও দার্শনিক উক্তি তাঁর বক্তৃতার অলংকার। তাঁর মতো মন্ত্রী যে কম, এটাই অবশ্য আনন্দের কথা। আমাদের কপাল ভালো, আর কোনো মন্ত্রী ৫৭ ধারা টিকিয়ে রাখায় এমন নিষ্ঠাবান নন! স্বয়ং আইনমন্ত্রীও যখন আইনটি বদলানোর আশ্বাস দিচ্ছেন, তখন তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ‘হৃৎকম্পন’ বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেকের। কেন বামপন্থী ঐতিহ্যের দাবিদার একজন মন্ত্রী মানুষের অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়াবেন? কলিকালে এ কী অবস্থা? কোনো অপরাধ ঘটার পর গোয়েন্দারা প্রথম প্রশ্ন করেন, ‘কুই বোনো’, মানে ‘কার লাভ?’ ঘটনা থেকে কে লাভবান হবে, সেটা খোঁজাই তদন্তের প্রথম ধাপ। আমাদেরও প্রশ্ন, ৫৭ ধারা টিকিয়ে রাখলে কার লাভ? সরকারপন্থী ও বিরোধী সবাই যখন আইনটি বাতিলের পক্ষে কথা বলছেন, তখন তথ্যমন্ত্রী কার স্বার্থে এটা টিকিয়ে রাখতে চান? মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫৭ ধারার বিষয়টি তুলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘সাংবাদিকদের নামে এই ধারায় মামলা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। এ সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। না হলে সমস্যা বাড়বে।’ যাতে সরকারের সমস্যা বাড়বে বলে মনে করছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল, তাতে তথ্যমন্ত্রীর এত উৎসাহ কেন? তিনি বলেছেন, ‘৫৭ ধারা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রণীত হয়নি। এটি গণমাধ্যমের বিষয় নয়। সাংবাদিকতার জন্য কারও বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়নি। মামলা হয়েছে সাইবার অপরাধের অভিযোগে, এটা সব নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।’ (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই)। কিন্তু এ বছরের প্রথম ছয় মাসে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৪টির বেশি মামলা হয়েছে। গত বছর হয় ৩৬টি। গত চার মাসে ১১টি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২১ জন সাংবাদিক। সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা করা হয়েছিল। গত মাসে প্রথম আলোর হাজীগঞ্জ প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয় প্রথম আলোয় দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের জের ধরে। উদাহরণ দিয়ে পাতা ভরা করা যাবে, তবু কি তাঁর টনক নড়বে? ৫৭ ধারা হয়ে উঠেছে বহুমুখী এক অস্ত্র। কাউকে পছন্দ না, কেউ বেশি সত্য কথা বলছে, কেউ আপনার ধান্দার বাধা? দিন মামলা ঠুকে। যে চাইবে, এই আইন তার। সর্বশেষ, সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একজন শিক্ষককে এই আইনে ফাঁসানো হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই অছিলা ফেসবুকের পোস্ট। ঢাবির ঘটনায় দুঃখপ্রকাশের শর্তে মামলা প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দেন বাদী। মৌখিক দুঃখপ্রকাশেই যে ‘অপরাধের’ নিষ্পত্তি করা সম্ভব, তার জন্য ৫৭ ধারার জামিন–অযোগ্য মামলা আর নিম্নে সাত বছরের জেল? এই আইন এক দুধারী তলোয়ার। যে ধরবে তারও হাত কাটবে, যে আঘাত খাবে সে তো যাবেই। বাংলাদেশে প্রতিটি সরব ও সক্রিয় শ্রেণি ও পেশার কেউ না কেউ এই মামলায় আক্রান্ত হয়েছেন। একজন মামলায় ফাঁসেন, চুপ করে যান সেই শ্রেণি-পেশার অনেকজন। অবস্থাটা এতই মারাত্মক, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল পর্যন্ত বলেন, ‘সরকারের ভেতরের একটি অংশ নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যে সংবাদমাধ্যমকে দমিয়ে রাখতে এ রকম আইনের পক্ষে গেছে। আর তথ্যমন্ত্রী একজন রাজনীতিক হয়ে ৫৭ ধারার পক্ষে সংসদে যে সাফাই গাইলেন, তা খুবই লজ্জাজনক। তিনি তো রাজনীতি করে এসেছেন, তিনি যদি আর্মির লোক হতেন, তবে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না।’ (প্রথম আলো, ২১ জুলাই)। সরকারের শুভানুধ্যায়ীরাও যখন এমন কথা বলছেন, তখনো তথ্যমন্ত্রী নাছোড়বান্দা। বিষয়টা বিস্ময়কর। ৫৭ ধারা এবং এ ধরনের আইন যত দিন থাকবে, তত দিন আইনের শাসন চাইতে ভয় লাগবে। আইনের শাসন কায়েম যদি হয় যে–কাউকে জামিন–অযোগ্য মামলায় যখন-তখন ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, যদি হয় সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের টুঁটিতে খিল লাগানো, তাহলে তেমন আইনের শাসন চাইতে সাহস হবে কার? ৫৭ ধারার ভয়ংকর এই সাতটি শব্দবন্ধ হলো: মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি। শোনা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে এর সবই থাকবে। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের এ খেলায় আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। যে–কারও যেকোনো নিরীহ কথাকেই এসব বিমূর্ত অভিযোগের ফাঁকে ফেলা সম্ভব। সবচেয়ে মারাত্মক হলো, ওপরের ওই সাতটি অপরাধ আদৌ করা হয়েছে কি না, তা নির্ধারণের ভার দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। পুলিশই অভিযোগ শুনে মামলা নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠাতে পারবে। তাহলে এই পুলিশ সদস্যকে একাধারে সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ, ভাষাবিদ, জনপ্রশাসনবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ধর্মবিশারদ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ হতে হবে। সেটা কি কারও পক্ষে সম্ভব? ৫৭ ধারা বাতিল হোক, অন্য কোনো নামে তা ফিরে না আসুক। এ ধরনের আইনের প্রয়োগের দিকে তাকালে আমাদেরও ‘হৃৎকম্পন’ হয়! দেশে এখন দুধরনের ‘হৃৎকম্পন’ দেখা যাচ্ছে। ছবি, কথা, কবিতা, সংবাদ, প্রতিবাদ দেখে কারও ‘হৃৎকম্পন’ বাড়তে পারে। আবার দমনমূলক আইনের খপ্পরে পড়ার ভয়েও অনেকের বুক তোলপাড় করা ‘হৃৎকম্পন’ হতে পারে। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। মুক্তিসংগ্রামের পথে উঠে আসা বিখ্যাত সেই গানটি উনি কি শুনেছেন: ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’?