নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা তফসিলবন্দী নয়

অালোকিত ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২৬ পিএম, বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই ২০১৭ | ২৩২
আনুষ্ঠানিকতার খুব একটা প্রয়োজন না থাকলেও নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির পথনকশা ঘটা করে আমাদের জানিয়েছে। এটি যদি ভোটার, ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা ব্যক্তি, সরকার, প্রশাসন, নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহী সবার কাছে নিজেদের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে, তাহলে কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে হবে। তবে একই সঙ্গে তাদের বোধ হয় এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে তাদের সব কাজেই স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করতে হবে। শুধু নিজেরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেই তারা খোলামেলা হবে, আর যখন কোনো ভুল করবে, বিতর্কের জন্ম দেবে, তখন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাবে, তেমনটি হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। প্রয়োজনীয় কাজটি সময়মতো না করে অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতায় গণতন্ত্রের যেমন উপকার হবে না, তেমনি জন-আস্থা অর্জনেও তা সহায়ক হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেদিন তাঁর পথনকশা ঘোষণা করলেন, সেদিন তিনি বলেছেন যে তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। তাই এ মুহূর্তে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির বিষয়ে সরকারকে কমিশন কোনো অনুরোধ করবে না। তাঁর এই বক্তব্যের কারণে প্রশ্ন উঠেছে, তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব কমিশন কীভাবে অস্বীকার করতে পারে? ধারণা করি, তাঁর এই বক্তব্যের পেছনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম দায়িত্বটুকুর চৌহদ্দির মধ্যেই নিজেদের আটকে রাখার মানসিকতা কাজ করেছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের কাজ এখন আর শুধু ভোটের ব্যবস্থাপনা নয়, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয়ের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাও এখন কমিশনের দায়িত্ব। এবং দেশে দেশে নির্বাচন কমিশনগুলোর দায়িত্বের পরিধি দিনকে দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে। ভোটার রেজিস্ট্রেশন, তালিকা প্রকাশ, সীমানা নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোর পাশাপাশি নির্বাচনের প্রধান অংশীদার—রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ বা তদারকিতেও কমিশনের ভূমিকা রয়েছে এবং তার পরিধি বাড়ছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও আইনগত কর্তৃত্ব রয়েছে। কমিশনে নিবন্ধিত কোনো দল যদি তাদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব সময়মতো জমা না দেয়, তাহলে সেই দলকে জরিমানা করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের। কোনো দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা হচ্ছে কি না, অর্থাৎ দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারা সম্মেলন করছে কি না, কিংবা দলের নির্বাহী কমিটির নির্বাচন হচ্ছে কি না—এগুলো দেখার দায়িত্ব কমিশনের। কোনো দল কমিশনের নির্ধারিত শর্তগুলোর কোনো একটি পূরণে ব্যর্থ হলে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিলের মতো ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে। কথা উঠেছে, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনবিষয়ক বিধি অনুযায়ী, পরপর দুবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে কমিশন সেই দলের নিবন্ধন বাতিল করে দিতে পারে বিধায় বিরোধী দল বিএনপি আগামী নির্বাচন বয়কট করলে তার নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রক বা তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশন যদি কোনো দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রাখে, তাহলে সেই দলের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও তো তাহলে তাদেরই নেওয়ার কথা। কোনো দল যদি ঘরে-বাইরে সভা করার সুযোগ না পায়, তাদের কার্যালয় যদি পুলিশ বা সরকার ছয়–নয় মাস বন্ধ রাখে, অথবা যেকোনো অজুহাতে তল্লাশি চালিয়ে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা দেয়, তাহলে তারা কীভাবে তাদের স্বাভাবিক সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে? আর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে না পারার কারণে যদি তারা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে পিছিয়ে থাকে, তাহলে তার দায় কার? সেখানে নির্বাচন কমিশনের দায় এড়ানোর সুযোগ কোথায়? কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। অনেকটা লোক দেখানো সংলাপের মধ্য দিয়েই এই কমিশনটি গঠিত হয়েছে। যে কারণে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার সমালোচনায় বলা হচ্ছিল যে সরকার ‘আমার কাম আমি করুম, তোরে খালি কইয়া লমু’ নীতি অনুসরণ করেই নতুন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়েছে। কমিশনারদের নিয়োগ–প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে সবার আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জটি কতটা কঠিন, তা নিয়েও যথেষ্ট কথাবার্তা হয়েছে। নতুন কমিশন যেন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্বাচনব্যবস্থার সুচর্চাগুলো অনুশীলনে উদ্যোগী হয়, সে জন্য এ বিষয়ে কমনওয়েলথ নীতিমালা অনুসরণের জন্যও নতুন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা হয়েছে (মেরুদণ্ড সোজা না রাখলে বিতর্ক পিছু ছাড়বে না, প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। নবনিযুক্ত কমিশনারদের একজন আমাকে বলেছিলেন যে এ বিষয়ে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের প্রকাশনাটি (ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট: এ কম্পেনডিয়াম অব কমনওয়েলথ গুড প্র্যাকটিসেস) তিনি আনিয়ে নেবেন। নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর হাতে গোনা যে কয়টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় সুচর্চা অনুসরণের কোনো চেষ্টা হয়েছে বলে প্রমাণ মেলেনি। আর জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্য তাতে আরও সংশয়ের জন্ম দেয়। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা, কাজ এবং দায়িত্ব সম্পর্কে কমনওয়েলথের ওই প্রকাশনা বলছে যে ‘নির্বাচন পরিচালনার পাশাপাশি দুই নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলায় ওই প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর ভূমিকা গ্রহণের বিধান সংবিধান ও আইনে থাকা উচিত।’ বিভিন্ন দেশে যেসব নির্বাচনী আইন চালু আছে, সেগুলোর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায় উল্লেখ করে এতে বলা হয়, অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকা উচিত, সেগুলো হচ্ছে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোটার রেজিস্ট্রেশন, রাজনৈতিক দল গঠন, তার রেজিস্ট্রেশন এবং তদারকি, দলীয় তহবিল এবং নির্বাচনী প্রচারের অর্থায়ন, নির্বাচনী প্রচারের আচরণবিধি, সেগুলো কার্যকর করা এবং বিরোধ নিষ্পত্তি। দুই নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের সংস্কৃতি গড়ে তোলা বা তাকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে আমাদের নির্বাচন কমিশন তাহলে কেন উদ্যোগী হবে না? কেন তারা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংগঠন করার ন্যূনতম অধিকারের সুরক্ষায় সহায়তা দিতে এগিয়ে আসবে না? বিপরীতে, নির্বাচনের দুই বছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলগুলো রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়ে দলীয় প্রতীকের জন্য ভোট চাইতে শুরু করলে কমিশন কেন তার চোখ বন্ধ রাখবে? নির্বাচনী ব্যয়ের আইন কেন তখন প্রযোজ্য হবে না? কমনওয়েলথ তার ৫৩টি সদস্যদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনসমূহ এবং প্রচলিত চর্চা বা রীতিনীতি পর্যালোচনা করে সুচর্চা বা বেস্ট প্র্যাকটিসের নীতিমালা সুপারিশ করেছে এই প্রকাশনায়। এতে ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যায় সুযোগ গ্রহণের চাপটিকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা বাড়তি সুবিধা নেওয়ার জন্য সুবিধাজনক সময়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো যাতে কাজে লাগাতে না পারে, সে জন্য এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনগত ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমনওয়েলথ ইলেক্টোরাল নেটওয়ার্ক ওয়ার্কিং গ্রুপ। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাব মোকাবিলায় কমনওয়েলথ বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী মনে করে যে সরকারপ্রধান পদে কোনো ব্যক্তি পরপর কয় মেয়াদে থাকতে পারবেন, তা ঠিক করে দেওয়ার আইন থাকা প্রয়োজন। তারা বিষয়টিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে এমন আইন তৈরির সুপারিশ করেছে যে আইন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা আদালতের রায় এমনকি গণভোটের মাধ্যমেও যেন বদলানো না যায়। প্রকৃতপক্ষে এই প্রকাশনাটি নির্বাচনকালীন এবং তার আগে বা পরে অনুসরণের জন্য একটি আদর্শ আচরণবিধি। নির্বাচনের বিষয়ে আরও বিশদ বিশ্লেষণ এবং গবেষণা রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। কম্পেনডিয়াম অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডস ফর ইলেকশন্স–এর চতুর্থ সংস্করণ বেরিয়েছে ২০১৬ সালে। এতে ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, আরব এবং এশিয়ার দেশগুলোর নির্বাচনী আইন এবং ব্যবস্থাগুলোর তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই প্রকাশনায় নির্বাচন–সম্পর্কিত সব আলোচনাই করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের রীতিনীতির আলোকে। এতে বলা হচ্ছে, মানবাধিকার প্রয়োগের দৃষ্টান্ত হচ্ছে নির্বাচন। আর জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা থেকে শুরু করে নির্বাচনবিষয়ক আলোচনার সব জায়গাতেই ‘প্রকৃত’ বা জেনুইন নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২১ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি হবে জনগণের ইচ্ছা; এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে নিয়মিত বিরতিতে এবং প্রকৃত নির্বাচনে...। প্রকৃত বা জেনুইন নির্বাচনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বৃহত্তর অর্থে ‘প্রকৃত’ বিশেষণটি দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকার, যেমন মতপ্রকাশ, সমাবেশ, সংগঠন ও চলাচলের স্বাধীনতার নিরিখে। আর ক্ষুদ্র অর্থে প্রকৃত নির্বাচনে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যায় এমন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও দলগুলোর মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার প্রকৃত সুযোগকে বুঝতে হবে। এরপর ১৯৬৬ সালে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারবিষয়ক যে আন্তর্জাতিক সনদ, আইসিসিপিআর গৃহীত হয়েছে এবং বাংলাদেশও যার স্বাক্ষরকারী, সেই দলিলের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদেও প্রকৃত নির্বাচনের কথাই বলা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনায় কোনো ঘাটতি নেই। মানুষ ভোট দিতে যে কতটা উদ্‌গ্রীব, তা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর ভোটের হারে বোঝা যায়। নির্বাচনের সততা বা ভোটের পবিত্রতা রক্ষার বিষযটি তাই রাজনৈতিকভাবে খুবই স্পর্শকাতর। সে জন্যই এ দেশে ‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব’ স্লোগান দিয়ে যেমন আন্দোলন হয়েছে, তেমনি কোটিখানেক ভুয়া ভোটারের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের আড়াই যুগ পরও আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। সন্দেহ নেই, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে আমরা প্রকৃত নির্বাচনই বুঝে থাকি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের অবসান না ঘটলে আমরা কীভাবে প্রকৃত নির্বাচন আশা করব? নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে বিতর্ক নিরসন না হওয়ার দায় যদিও আজিজ কমিশন ও রকিব কমিশনেরই বেশি, তবু নতুন কমিশনকেই এখন সাহসী হয়ে আশা জাগাতে হবে। না হলে নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ যে আবারও সংকটে নিপতিত হবে, সেই আশঙ্কা থেকেই