মানবদেহে মারাত্মক ক্ষতির আশস্কা
মধুপুরের আনারসের তিন ধফায় রাসায়নিক স্প্রে
টাঙ্গাইলের মধুপুরের রসে ভরা আনারসের মৌ-মৌ গন্ধে সারা দেশজুড়েই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। বাংলাদেশের আনারসে রাজধানী খ্যাত মধুপুরে আনারস চাষীর সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে দেশব্যাপী আনারসের চাহিদাও। তবে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে আনারসের গুনগতমান দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।
মুলত জুন জুলাই আনারসের প্রধান মৌসুম হলেও এখন সারা বছরই কম বেশি উৎপাদন হচ্ছে মধুপুর গড় অঞ্চলে।
সাধারণত বাগানে ফল পরিপক্ক হতে প্রায় ৫-৬ মাস সময় লাগে আর এই ৫-৬ মাসের আগেই আগাম ফল পেতে তিনবার রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। প্রথমেই ফুল আসতে শুরু করে তখনই মাত্রাতিরিক্ত প্যানোফিক্স স্প্রে করা হয়। আবার কিছুুদিন পর আনারসটির আকৃতি বড় করার জন্য মাত্রাঅতিরিক্তি সুপার ফিক্স হরমোন এবং সর্বশেষ কৃত্রিমভাবে পাঁকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথ্রেল বা রাইপেন ব্যবহার করা হয়। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। প্রতিনিয়ত এই রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহার করলেও এটি বন্ধে প্রশাসনিকভাবে কোন উদ্যোগ নেই। যার ফলে আনারস চাষীরা অধিক লাভের আশার প্রতিনিয়ত এই রাসায়নিক কেমিক্যাল বাগানে ব্যবহার করছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিস ( এআইএস) এর তথ্য অনুয়ায়ী, ক্যালসিয়াম কার্বাইড এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ। যা ফলমুলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত পদার্থে রূপাস্তরিত হয়। কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম রোগ বিশেষ করে বদহজম, পেটেরপীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মহিলারা এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। শিশুরা বিষাক্ত পদার্থের বিষক্রিয়ার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জানা যায়, কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের সময় ইউরোপে নিয়ে আসেন আনারস। পতুর্গীজরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা ভারতের কেরালা হয়ে আনেন মেঘালয়ে। আর ১৯৫৩ সালে মেঘালয়ে থেকে মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামে গারো মিজিগারনী প্রথম কেলেন্ডার বা বিলিতি জাতের আনারস আনেন। তারপর মিজিগারনীর নাতি জন বেরুনা রিসিল চিছিম এর মাধ্যমে পুরো মধুপুর অঞ্চলে এ আনারসের বিস্তার ঘটে। জন বেরুনা রিসিল চিছিম ১৯৭৭ সালে গড়ে তুলেন ইদিলপুর আনারস চাষী বহমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। এখন এ সমিতির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪’শত।
মধুপুর গড়ের মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া ও ঘাটাইল উপজেলায় প্রায় ২১ হাজার একরে ছড়িয়ে পড়েছে আনারস চাষ। তবে এর সিংহভাগই চাষ হয় মধুপুর উপজেলায়। অরুণখোলা, ষোলাকুঁড়ি, আউশনাড়া ইউনিয়নে আনারসের সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। এসব এলাকায় চাষ হওয়া আনারসের মধ্যে জনপ্রিয় আনারস হল হানিকুইন, জলডুগি,ঘোড়াশাল, কেলেন্ডার বা বিলিতি জাতের আনারস । এছাড়া বর্তমান সময়ে জায়ান্টকিউ ও ফিলিপাইনের এমডিটু জাতের আনারস চাষেও ঝুঁকেছেন এ এলাকার চাষীরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এগিয়ে এসেছিল এই আনারস বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার কাজে। সংস্থাটির পক্ষে থেকে ইদিলপুর আনারস চাষী বহমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মাধ্যমে ৩২ কোটি টাকার প্রজেক্ট তৈরি করে ৩০টি ইন্ডাষ্ট্রিজ করার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে আনারস বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে। সংস্থাটি কর্তপক্ষ ভিজিটে আসলে, ফলের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ও আর্থিক ব্যবস্থপনায় অসংগতি হওয়ার কারণে সে বছরই বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি । যার ফলে আনারসের বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া ২০১৭ সালে ইদিলপুরে নেদারল্যান্ড ও বাংলাদেশ জয়েন ভেঞ্চারে বাংলাডাচ ডেভেলপ্টমেন্টস লিমিটেড ফ্রুটস প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রি নামে একটি কোম্পানি গড়ে ওঠে বাজারজাত প্রক্রিয়াকরণে। বেশকিছু দিন আনারস এবং কলা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হলেও শেষ পর্যন্ত ইউরোপে ঠিকমত মার্কেটিং না করতে পারায় এ বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াও কোম্পানি কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আউশনাড়া ইউনিয়নে ইদিলপুর ও বুকারবাইত গ্রামের রাস্তার দুই পাশেই শতশত আনারসের বাগান। বাগানে আনারসের সাথে সাথী ফল হিসেবে পেঁপে, কলা, আদাঁ, গারো কচুঁ (পঞ্চমুখী) চাষ করা হচ্ছে। ক্ষেত পরিচর্যা, আনারস কাঁটায় ব্যস্ত অনেকেই। ভ্যানওয়ালারা ব্যস্ত পরিবহনে আনারস তোলা। ভোর থেকেই জলছত্র বাজারের চারপাশ থেকে সারিসারি বাহন ভরে বাজারে নামছে এই আনারসের ঢল। কোন শুক্র-শনি নাই। আগামী কার্তিক মাস পর্যন্ত চলবে আনারস কেন্দ্রিক এই বিকিকিনি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০-১৫০ ট্রাক ছোট বড় মিলে যায় দেশের নানা জেলায়। এছাড়াও মোটের বাজার, গারোবাজার, সাগরদিঘী ও আশ্রাবাজারেও জমে উঠেছে আনারসের কেনাবেচার হাট বাজার।
কথা হয় বুকারবাইত গ্রামের আনারস চাষী তুলা মিয়ার সাথে, তিনি বলেন ১ লিটার প্যানোফিক্স ১৮০০ টাকা দিয়ে কিনে বাগানে তিনধাপে স্প্রে করি। এতে তাড়াতাড়ি ফুল আসে ফল বড়ও হয় এবং দুই তিন দিনের মধ্যেই পাকে। এছাড়াও সুপার ফিক্স, ওকুজিন, কপসকিয়ার নামের হরমোন দিলে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ৩ থেকে ৫ কেজি ওজনের আনারসে পরিনত হয়।
একই গ্রামের আরেক আনারস চাষী ইব্রাহীম বলেন, ক্রেতারা তো ভালো জিনিস খাইতে চায় না। ক্রেতা পছন্দ করেন রঙ,সাইজ । আগাম খাইতে পছন্দ করেন। হরমোন না দিলে আনারস পাকে একবারে শেষ দিকে। আর কেমিক্যাল না দিলে ফলের চেহারা হবে কালো। সাইজ হবে ছোট ও মাঝারি। কৃষক এই আনারস বেচঁতে পারবে না। ব্যাপারিও এ ধরণের আনারস নিতে চায় না। কারণ শহরের মানুষ তো এই আনারস কেনেন না।
জলছত্রের মেসার্স বিপ্লব ট্রের্ডাস এর রফিকুর ইসলাম বলেন আমার প্রতিদিন ৩-৪টি গাড়ি বের হয়। এ আনারস যায় বগুড়া,নওগা,রংপুর,পাবনা,চাটমোহর এসব জায়গাতে। আজও গাড়ি চাটমোহর যাচ্ছে ১ হাজার পিচ আনারস নিয়ে এর দাম হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা। দাম এখন কিছুটা কম যাচ্ছে। কেমিক্যাল প্রসেঙ্গ তিনি বলেন আমরা আরৎদার চাষীরা বাগানে ফল বড় ও পাঁকতে এ ধরণের বিষ ব্যবহার করে। বিষ ছাড়া আনারস এখন আর মধুপরে নাই।
ঘুুঘুদিয়া গ্রামের উদ্যাক্তা ও ১৫ বছর ধরে আনারস নিয়ে কাজ করছেন মো আবুল হোসেন। তিনি বলেন, এ মধুপুরের আনারস এখন পশুপাখিও খায় না খায় শুধু মানুষ। অথচ কয়েক বছর আগেও বাগান পাহাড়া দিতে হত দিনরাত ২৪ ঘন্টা। এখন মধুপুরে একজনও চাষী নেই যারা এই কেমিক্যাল ব্যবহার না করছে। এই মধুপুরেই প্রায় ৪০টির মতো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি আছে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে। এ সব কেমিক্যাল ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ শুধু এসেম্বল করছে, কোম্পানি তারা এখানে ব্যবসা করছে সরকারকে ভ্যাট দিয়ে। এ কারণে কৃষকের ওপর দোষ না দিয়ে কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
ইদিলপুর আনারস চাষী বহমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক বলেন,ওষুধ না দিলেও আনারস পাকে, কিন্তু রং আসেনা। যার ফলে ক্রেতা,ব্যাপারী কেউও ফল নেয় না। হরমোন নিয়ে মধুপরে কোন গবেষণা কেন্দ্র নেই। কৃষকদেরও কোন প্রশিক্ষণ নাই। যেখানে ১৬ লিটার পানিতে ৫ মিলি লিটার হরমোন স্প্রের অনুমোদন আছে কৃষি অধিদপ্তরের, সেখানে কৃষক কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর পরামর্শে ভুল সময়ে ব্যবহার করে ১০০ থেকে ২০০ এমএল। যেটা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি দিয়ে থাকে। আমাদের সমিতির পক্ষে থেকে চেষ্টা করছি চাষীদের বিষমুক্ত আনারস চাষ করতে। একটু সময় লাগবে তবে আগের মত বিষমুক্ত আনারস চাষ হবে।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল কে বলেন, এবছর ৬ হাজার ৫৮২ হেক্টর জমিতে চাষকৃত আনারস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। আনারসের ফলন এবার অনেক ভাল হয়েছে।
আনারসে মাত্রাঅতিরিক্তি ক্যালসিয়াম কার্বাইড,প্যানোফিক্স,রাইপেনের মত কেমিক্যাল স্প্রে প্রসেঙ্গ তিনি সতত্যা স্বীকার করে বলেন বিষাক্ত কেমিকেল ব্যবহার থেকে কৃষকরা সরে আসতেছেন। আমাদের পক্ষে থেকে নিয়মিত চাষীদের সচেতন করা হচ্ছে এবং অনেক চাষীই এখন বিষমুক্ত আনারস চাষ করছেন। সব কেমিক্যালের অনুমোদনও নাই আমরা এ বিষয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন দোকানদারদের জরিমানা করছি।
তিনি আরোও বলেন, এ মধুপুরে এখন ফিলিপাইনের এমডিটু জাতের আনারস চাষ হচ্ছে। আগামী বছর থেকেই মধুপুরের এ আনারস দেশের বাইরেও প্রসেসিং করে রপ্তানি করার প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর এগ্রো ফরেষ্ট্রি প্রধান প্রফেসর ড. কাজী কামরুল ইসলাম কে বলেন, মধুপুরের আনারসে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এ আনারস খাওয়ার ফলে মানবদেহে প্রাথমিক ভাবে বদহজম, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা, বমি, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, স্কীনের সমস্যা হচ্ছে। আস্তে আস্তে মানবদেহে বড় ধরনের হার্টের সমস্যা, কিডনি নষ্ট সহ ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। অবিলম্বে আনারস চাষীদের এ কাজ থেকে বিরত রাখতে সকলকে সচেতন করতে হবে।