যমুনার ভাঙনে দিশেহারা চরপৌলীবাসী

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: ০৫:০০ পিএম, বুধবার, ২৫ মে ২০২২ | ৪১১

অসময়ে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি আর তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পরেছেন চরপৌলী গ্রামের সাধারণ মানুষ। গত সাতদিনেই যমুনা নদী ঘেঁষা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী ও উত্তর চরপৌলী গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক বসত ভিটে পরেছে ভাঙন কবলে।

বিশ্বমহামারি করোনা প্রভাব কাটিয়ে উঠার সংগ্রামের মাঝেই যমুনার তীব্র ভাঙনে এখন প্রায় নিঃস্ব এ এলাকার ভুক্তভোগীরা। ত্রাণের পরিবর্তে দ্রুত ভাঙন ঠেকানোর উদ্যোগে নেয়াসহ সহায় সম্বল রক্ষার্থে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এছাড়াও যমুনার তীরবর্তী কালিহাতী উপজেলার আলীপুর, হাটআলীপুর, ভৈরববাড়ি, বিনোদলুহুরিয়া, কুর্শাবেনু গ্রামে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। যমুনার ডানতীরে পাউবো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করায় এবং যমুনার মাঝখানে নতুন চর জেগে উঠার কারণে বাম তীরে ভাঙনের এই তীব্রতা বেশি লক্ষ করা গেছে।

এক সপ্তাহে ওইসব এলাকার সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙন কবলিতরা অন্যের বা আত্মীয়ের বাড়িতে, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে ভাঙনের শঙ্কায় ওই এলাকায় বসবাসকারীরা বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর সেতুর দেড় কিলোমিটার ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেকে) পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) চারটি পৃথক লটে ২৩৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকায় ১৫৩০মিটার গাইড বাঁধ (অফটেক বাঁধাই) নির্মাণ করে। যমুনার মাঝ বরাবর নতুন চর জেগে উঠায় পানির তীব্র ¯্রােতের ফলে গাইড বাঁধের ১ নম্বর লটের বিভিন্ন অংশে ইতোমধ্যে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। অফটেকের ভাটিতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে সদর উপজেলার চরপৌলী,উত্তর চরপৌলী আর কালিহাতী উপজেলার আলীপুর, হাটআলীপুর, ভৈরববাড়ি, বিনোদলুহুরিয়া, কুর্শাবেনু গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে জানা যায়, যমুনায় পানি বাড়ার সময় এবং পানি কমার সময় প্রতিবছর ওইসব এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। তবে এবছর বর্ষার আগেই ভাঙন শুরু হয়েছে। গত সাতদিন যাবৎ ভাঙনের তীব্রতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।  

সরেজমিন দেখা গেছে, নদী তীরের মানুষ ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। গাছগুলোও কেটে নিয়ে যাচ্ছেন- যাতে নতুন বাড়ি তৈরিতে কাজে লাগাতে পারেন। বঙ্গবন্ধুসেতুর ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরীর অফটেক বাঁধাইয়ের পর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার কর্মযজ্ঞ চলছে। ইতোমধ্যেই চরপৌলী গ্রামের ইউনুস মন্ডলসহ ভাঙনে বিলীন হয়েছে ওই এলাকার আব্দুর রশীদ শেখ, খন্দকার আলমাস মিয়া, কাশেম মন্ডলের বাড়ি। সর্বশ্য হারানোর ভয়ে রয়েছে এখন ভাঙন কবলিত দশ হাজার ভোটারসহ এ তিনটি ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষ। ভাঙনের আভাস পেয়ে কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ অন্যান্যরা বাড়ি ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু হতদরিদ্র গ্রামবাসি আবার টাকার অভাবে বাড়ি ঘর সড়িয়ে নিতেও পারচ্ছেন না বলে ভুক্তভোগীদের তথ্য জানা গেছে।

চরপৌলী গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মো. মাজম আলী ভূইয়া (৮৫) বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমার প্রায় সাড়ে ৪২ বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। চলতি ভাঙনেই গেছে প্রায় দেড়-দুই বিঘা জমি। এখন ভাঙনের কবলে রয়েছে ৮০ শতাংশের উপর গড়া বাড়ির জমিটুকু। ভাঙনের ভয়ে ঘর গুলো সড়িয়ে নিতে পারলে জমি রক্ষার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্যত্র ঘর করতে বাড়ির জমিতে রোপনকৃত কিছু গাছ কেটে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরপরও গ্রামটি রক্ষার্থে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

ওই গ্রামের শাহাদত বলেন, এ বছর বন্যা না আসতেই ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। মাত্র পাঁচদিনে ৩৫০ হাত জমি বিলীন হয়েছে এ গ্রামটির। এত ভয়াবহ ভাঙন অন্যান্য বছরের বন্যায় হয়নি বলেও জানান তিনি।

কাকুয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আল আমিন জানান, মাত্র সাতদিনেই ভাঙন কবলিত তিনটি ওয়ার্ডের পাঁচ শতাধিক ঘর বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর বেশিরভাগ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। তাদের অনেক দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।  ভাঙন ঠেকাতে পানি উনয়ন বোর্ড কিছু জিও ব্যগ ফেলার কথা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যদি জিরো পয়েন্ট থেকে কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হলে এলাকাবাসির কিছু উপকার হবে। 

তিনি আরও বলেন, ভাঙন কবলিত এ ওয়ার্ড গুলোর মধ্য থেকে গত বছর সিংগুলি, গয়লা আসন আর জিদারগোল গ্রামটি বিলীন হয়ে গেছে।

ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, ভাঙনের কারণে এ নিয়ে চারবার তাকে বাড়ি ঘর সড়িয়ে নিতে হচ্ছে। তবে চলতি বছর অসময়েই নদীর তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। গেল মাত্র সাতদিনেই এ ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এখন শুধু সময়ের দাবি নয়-জরুরি। তা না হলে আগামি ২-১ বছরের মধ্যে সদর উপজেলার মানচিত্র পাল্টে যাবে। এ বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও জানেন।

তিনি আরও জানান, চলতি সপ্তাহের স্থানীয় সংসদ সদস্য ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ত্রাণ দিয়েছেন। তবে বিপর্যয়ের এই মুহুর্তে ভুক্তভোগীদের ত্রাণের চেয়েও বেশি প্রয়োজন নগদ অর্থ সহায়তা। ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য অর্থ সহায়তার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, যে ভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে জরুরি কাজ করে এ ভাঙন ঠেকানো যাবে না। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। দ্রুত সে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হবে। আগামি শুষ্ক মৌসুমে ভাঙন কবলিত স্থানে স্থায়ী বাঁধের কাজ শুরু করা হবে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ¦ মো. ছানোয়ার হোসেন জানান, একনেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মাহমুদনগর থেকে চরপৌলী পর্যন্ত ১৫.৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন হয়েছে। এর জন্য দুটি টেন্ডারে ৪২ কোটি আর ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দেরও অনুমতি হয়েছে। এছাড়াও এ বাঁধ নির্মাণের টেন্ডার ডকুমেন্টটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। টেন্ডারটি খুব দ্রুত পাশ হয়ে যাবে। তবে এরপরও বর্ষায় কাজটি শুরু করা যাচ্ছে না। আশা করছি আগামি বছরই আমরা শুষ্ক মৌসুমে বাঁধের নিমার্ণ কাজ শুরু করতে পারবো।