গর্ভবতী যে শিশুকে ঘিরে তোলপাড় ভারতে


১০ বছরের নিষ্পাপ এক শিশু। স্বজনরা বলছেন, সে অত্যন্ত শান্ত এবং নম্র। নম্র এই শিশুর জীবনকে বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিয়েছেন কাছের এক আত্মীয়। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী এই শিশু নির্মমতার শিকার হয়ে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
ভারতের উত্তরাঞ্চলের চান্দিগরের এই শিশু (১০) গর্ভবতী। তার গর্ভপাতের জন্য আদালতে আবেদন করলেও সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ভারতীয় আইন অনুযায়ী, ২০ সপ্তাহের বেশি গর্ভবতী হলে গর্ভপাতের সুযোগ নেই। আদালত গর্ভপাতের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার পর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে এই বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
‘‘তাকে বলা হয়েছে যে, তার পেটে বড় একটি পাথর আছে। যে কারণে সে মোটা হচ্ছে।’’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির গীতা পাণ্ডে ভারতের উত্তরাঞ্চলের শহর চান্দিগরে গিয়ে ১০ বছরের শিশুর গর্ভবতী হয়ে পড়া এবং এরপরের সৃষ্টু জটিলতার চিত্র তুলে ধরেছেন এক প্রতিবেদনে। চান্দিগর স্টেট লিগাল সার্ভিস অথরিটির মহাবীর সিং বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভধারণের অনেক ঘটনা দেখেছি। কিন্তু এটাই প্রথম কোনো ঘটনা যে, ১০ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঘটেছে।’
মহাবীর সিং এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। চান্দিগড়সহ পুরো ভারতে আলোড়ন তুলেছে আত্মীয়র পাশবিকতার শিকার ১০ বছরের শিশুর এই গর্ভধারণের ঘটনা। ওই আত্মীয় এখন কারাগারে; মামলা বিচারাধীন।
আমোদ-প্রমোদে উল্লসিত থাকা এই শিশুকে সুখী হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে; যার মুখে সহজেই হাসি ফুটে ওঠে। অত্যন্ত লাজুক এবং খুব বেশি কথা বলে না। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী শিশুটির পছন্দের বিষয় গণিত এবং ইংরেজি। সে আঁকতে পছন্দ করে এবং অাঁকাআঁকিতে তার হাত যথেষ্ট পাকা। পছন্দের কার্টুন ছোটি আনন্দি (ছোট আনন্দ) এবং শিন চ্যান। চিকেন, মাছ এবং আইসক্রিম তার পছন্দের খাবার।
গত ২৮ জুলাই ৩২ সপ্তাহের গর্ভবতী এই শিশুর গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে করা এক পিটিশন প্রত্যাখ্যান করেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সন্তান জন্মদানের কাছাকাছি রয়েছে সে। চিকিৎসকদের একটি প্যানেল আদালতকে পরামর্শ দিয়ে বলেছে যে, এই সময়ে গর্ভপাতা করা হলে শিশুটির জীবন প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়বে। তবে আদালতের ওই নির্দেশ হতাশ করেছে শিশুটির পরিবারকে।
কী ঘটছে, জানে না শিশুটি
ভারতের আইনে ২০ সপ্তাহের বেশি সময়ের গর্ভবতী কোনো মাকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই। চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন যে, এই সময়ের পরে গর্ভপাত ঘটালে ঝুঁকির মুখে পেড়ে মায়ের জীবন।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির আদালতে বেশকিছু পিটিশন দায়ের করা হয়। এদের মধ্যে অনেকগুলোই করা হয়েছে ধর্ষণের শিকার শিশুদের পরিবার থেকে; যারা ২০ সপ্তাহ পরে গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এসব গর্ভধারণের কথা জানাজানি হয় দেরিতে; কারণ শিশুরা এই বিষয়ে সচেতন নয়।
১০ বছরের এই শিশুর ক্ষেত্রেও মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তার গর্ভধারণের বিষয়টি জানাজানি হয়। এই সময় তার তলপেটে ব্যথা শুরু হয় এবং তার মা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। শিশুটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে; এমন এক ব্যক্তি বলছেন, সে একেবারেই নিষ্পাপ। কী ঘটেছে সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
শিশুটি স্বাস্থ্যবান হওয়ায় তার বাবা-মাও খেয়াল করেননি যে তার শরীরে পরিবর্তন আসছে। তারা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না যে মাত্র ১০ বছর বয়সে তাদের সন্তান গর্ভবতী হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য শিশুটিকে এখনো তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি জানানো হয়নি। তাকে বলা হয়েছে যে, তার পেটে বড় একটি পাথর আছে। যে কারণে সে মোটা হচ্ছে।
তাকে স্পেশাল ডায়েটে রাখা হয়েছে। ডিম, দুধ, ফলমূল, মাছ ও চিকেন খেতে দেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত যত্ন নেয়ার বিষয়টি সে উপভোগ করছে। কিন্তু সম্প্রতি তার বাড়িতে পুলিশ, সমাজকর্মী ও পরামর্শকদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এছাড়া তার বাড়ির বাইরে শুরু হয়েছে ‘মিডিয়া সার্কাস’।
চান্দিগরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, আসল সমস্যা ও পরিস্থিতি সে (শিশুটি) এখনো বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি মনে করি, সে এখন কিছুটা ধারণা পাচ্ছে। তার বাবা-মা পরিস্থিতি মোকাবেলায় লড়াই করছেন। দরিদ্র এই পরিবার এক রুমের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছে। শিশুটির বাবা সরকারি কর্মচারী এবং মা অন্যের বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করেন।
দেশটির নারী পুলিশের সদস্য প্রতীভ কুমারি এই ঘটনায় তদন্ত করছেন। পরিবারটিকে ‘অত্যন্ত সুন্দর পরিবার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। যারা একেবারেই অতি-সাধারণ। এমনকি তারা এখনো কল্পনা করতে পারেন না যে, তাদের ওই স্বজন এই ঘটনা ঘটাতে পারে।
শিশুটি তার বাবা-মাকে বলছে, সে তাদের কাছে বোঝা হয়ে উঠছে। ‘তার মা কান্না ছাড়া আমার সঙ্গে কখনো কথা বলতে পারেননি। শিশুটির বাবা বলছেন, তিনি মনে করেন তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।’
ভারতে ধর্ষণ চিত্র
>>প্রতি ১৫৫ মিনিটের মধ্যে ১৬ বছরের কমবয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
>>প্রতি ১৩ ঘণ্টায় ১০ বছরের নিচের অন্তত একজন শিশু ধর্ষিত হয়।
>> ২০১৫ সালে দেশটিতে অন্তত ১০ হাজার শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
>> ভারতে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়েছে এমন নারীর সংখ্যা অন্তত ২৪ কোটি।
>> সরকারি এক জরিপে অংশ নেয়া ৫৩.২২ শতাংশ শিশু বলছে, তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশই পরিচিতজনদের কাছে ঘটেছে।
সূত্র : ভারত সরকার, ইউনিসেফ
কী ঘটবে শিশুটির ভাগ্যে?
পরিচিতরা বলছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি শিশুটি সন্তানের জন্ম দেবে। চিকিৎসকরা সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হলে তার আগেই সিজার করা হতে পারে।
এদিকে মেয়েটির পরিবার কোনো কিছু করতে রাজি না হওয়ায় অনাগত শিশুটির দেখাশোনার দায়িত্ব শিশু কল্যাণ সমিতিকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
মেডিকেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ বছর বয়সী এই শিশুটিকে মানসিক আঘাত থেকে বাঁচাতে হবে। এজন্য বছরের পর বছর মনোবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে তার কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হবে।
এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, আমরা বেশ চিন্তায় আছি। ১০ বছরের একটি শিশু কি সন্তান জন্ম দিতে পারে? এটা কি তার জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে? সেরকম কোনো কিছুই যেন না ঘটে; আমরা সে প্রার্থনাই করছি। (সংক্ষেপিত)
বিবিসি অবলম্বনে সাইফুজ্জামান সুমন