সাপাহারে ১৩ সেপ্টেম্বরে ডুকরে কেঁদে ওঠে উপজেলাবাসী

গোলাপ খন্দকার সাপাহার (নওগাঁ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ২৪৪

প্রতি বছরের ন্যায় সাপাহারবাসীদের কাঁদাতে ও ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল দিনটি স্মরণ করিয়ে দিতে আবারো ফিরে এলো সেই ১৩ই সেপ্টেম্বর।

এই দিনে উপজেলার বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী মুক্তি যোদ্ধা শত্রু সেনাদের কবল থেকে সাপাহারবাসীকে মুক্ত করতে গিয়ে তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন ও বেশ কয়েকজন আহত হন। তাই প্রতি বছর এই দিনে অনেক সন্তান হারা মা, ভাই হারা বোন তাদের সেই নিহত সন্তান ও স্বজনদের কথা স্মরণ করে নিরবে চোখের পানি ফেলেন ও মাঝে মধ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

এলাকার কয়েকজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের নিকট থেকে জানা যায়। ১৯৭১সালে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অন্যান্য এলাকার মত তৎকালীন স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকারদের বেপরোয়া চলাফেরায় সাপাহার উপজেলা পাকিস্তানী বাহিনীর দখলে চলে যায়।

বর্তমান উপজেলা সদরের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এলাকাকে তারা তাদের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে আর এখান থেকেই তারা প্রতি দিন এলাকার চিহিৃত রাজাকারদের দেয়া নির্দেশ মত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সাধারণ নিরিহ মানুষের ধন-সম্পদ লুট,পাট মা বোনদের ইজ্জত হরন করে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।

যুদ্ধের প্রায় ৬মাস অতিবাহিত হলে সেপ্টেম্বর মাসে বাঙ্গালীদেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মত অবস্থায় সাপাহারবাসীকে মুক্ত করতে সাপাহার উপজেলার ও পার্শ্ববর্তী মহাদেবপুর উপজেলার ৮০জন মুক্তি যোদ্ধার একটি সংগঠিত দল সাপাহারে অবস্থানরত শক্তিশালী তৎকালীন পাকিস্তানী মিলিটারী বাহিনী লেঃ শওকত আলীল ওই সু-সজ্জিত ঘাঁটিটি চীরতরে উৎখাত করে সাপাহারবাসীকে নরপিচাশদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য গোপনে এক বৈঠক করে দৃঢ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় তারা।

শেষে সময় ও সুযোগ বুঝে ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে মুক্তি যোদ্ধারা সজ্জিত দলটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি উপদলকে সাপাহার-মধইল রাস্তার মধইল ব্রিজে বাহিরের শত্রুদের গতি বিধি দেখার জন্য রাখা হয় আর মুল দলটি ওই বিদ্যালয়ের উত্তর পূর্ব দিকে একটি ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়।

ঠিক এসময় দেশের রাজাকার আলবদর মারফত মুক্তি যোদ্ধাদের আক্রমনের সংবাদ পৌঁছে যায় শত্রু শিবিরে তাৎক্ষনিক তারাও যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহন করে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে ভোর রাতে আক্রমন চালায় ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়া দলটি, পাইলট মাঠ থেকে শত্রু সেনারাও পাল্টা আক্রমন চালাতে শুরু করে।

ঘন্টাকাল ব্যাপী এক টানা যুদ্ধের পর মুক্তি যোদ্ধার দলটি যখন পাক সেনাদের প্রায় কোন ঠাসা করে ফেলেছিল ঠিক তখনই ভোরের আভাস পেয়ে মধইল ব্রীজে অবস্থান নেয়া মুক্তি যোদ্ধার উপ দলটি সেখান থেকে সরে পড়ে আর সে মহুর্তে পত্নীতলা উপজেলা সদর ও মধইল বাজার এলাকা থেকে অসংখ্য পাক সেনারা অত্যাধুনিক অস্ত্র স্বস্ত্র নিয়ে সাপাহারে প্রবেশ করে।

নতুন শত্রু সেনার অনুপ্রবেশে শত্রুবাহিনীর শক্তি দ্বিগুন হারে বেড়ে যায় এবং তারা এক সময় স্বল্পসংখ্যক মুক্তি যোদ্ধার দলটিকে ধরাশায়ী করে ফেলে।

এসময় শত্রু সেনার গুলির আঘাতে যুদ্ধের মাঠেই শাহদাত বরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল হামিদ সহ ১৫জন। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহম্মদ উল্লাহ, সোহরাব হোসেন, নুরুল ইসলাম সহ অনেকে।

এ ছাড়া শত্রুদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন ৮জন। এসময় শত্রু সেনারা যুদ্ধের মাঠ থেকে সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু ওয়াহেদ গেটের, মহাদেবপুর উপজেলার এসএম জাহিদুল ইসলাম সহ ৮জন মুক্তি যোদ্ধাকে ধরে এনে মধইল স্কুলের ছাদে তুলে ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে লাথি মেরে লাশ ছাদ থেকে মাটিতে ফেলে দেয়। অপর ২জনকে মহাদেবপুর এনে একটি কুপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয় আর দুজনকে নাটোর জেলাসদরে ধরে এনে তৎকালিন তাদের তৈরীকৃত রাজবাড়ীর জেলখানায় বন্দী করে রাখে।

পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এস এম জাহিদুল ইসলাম ঘটনার বর্নণা দিতে গিয়ে এই প্রতিবেদকের সামনে হাউ, মাউ করে কেঁদে ফেলেন ও ঘটনার বর্নণা দেন। তাই আজকের এই দিনে সাপাহারে অনেকে দিনটির কথা স্মরণ করে অঝোরে তাদের চোখের পানি ফেলেন ও ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

উল্লেখ্য যে, প্রতিবছর দিনটি ঘুরে এলেও দিনটি স্মরণে কোন স্মরণসভা কিংবা দিবসটি উদযাপন করা না হলেও সাপাহারের সাংবাদিকগন তাদের স্ব-স্ব পত্রিকায় দিনটি স্মরণে দিবসটির বর্ননা লিখে ঘটনাবলীর স্মরণ করে থাকেন।