ক্ষীণ হয়ে আসছে গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা


দোহায় কাতার সরকারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় নিয়ে চলমান আলোচনা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আলোচনার মূল ইস্যুগুলোতে কোনো গঠনমূলক অগ্রগতি হয়নি, বরং ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করছে। খবর বিবিসি।
একজন জ্যেষ্ঠ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন সফরের সময় কৌশলগতভাবে এমন একটি প্রতিনিধিদল দোহায় পাঠিয়েছে যারা কেবল সময় ক্ষেপণ করছে। আলোচনার মূল ইস্যুগুলোতে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই এ প্রতিনিধি দলের। এসব ইস্যুর মধ্যে রয়েছে গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার ও মানবিক সহায়তা বিতরণের পদ্ধতি।
তবে যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে ফেরার আগে নেতানিয়াহু আশাবাদী সুরে বলেন, তিনি আশা করছেন কয়েক দিনের মধ্যেই একটি চুক্তি সম্পন্ন হবে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই চুক্তির আওতায় হামাস ২০ জীবিত জিম্মির অর্ধেক ও ৩০ মৃত জিম্মির অর্ধেকের কিছু বেশি সংখ্যককে মুক্তি দেবে। যুদ্ধবিরতি ৬০ দিন স্থায়ী হবে।
গত রোববার থেকে শুরু হয়ে দোহায় এখন পর্যন্ত আট দফায় প্রক্সি আলোচনা হয়েছে। হামাস ও ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা আলাদা ভবনে অবস্থান করে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে বার্তা বিনিময় করছেন। মধ্যস্থতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানী ও মিশরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
তবে শুক্রবার রাতে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানান, আলোচনা এখন ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। মানবিক সহায়তা বিতরণ ও ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার—এই দুটি বিষয়েই বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়ে গেছে। হামাস চায়, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ ও বিতরণ হবে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। অন্যদিকে ইসরায়েল চাইছে বিতরণ হবে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন নামে একটি বিতর্কিত ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ব্যবস্থার মাধ্যমে। মধ্যস্থতাকারীরা বলছেন, এ ইস্যুতে কিছুটা অগ্রগতি হলেও এখনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি।
দ্বিতীয় প্রধান বিতর্ক ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার নিয়ে। পঞ্চম দফার আলোচনায় ইসরায়েল জানায়, তারা গাজার ভেতরে ১ থেকে ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার গভীর একটি সীমিত বাফার জোন রাখতে চায়। হামাস এটিকে আপসের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু পরে যখন তারা ইসরায়েলি প্রত্যাহারের মানচিত্র চায়, তখন দেখা যায় সেখানে বাফার জোন অনেক বেশি গভীর। এছাড়া ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতি দেখানো হয়েছে।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ইসরায়েলকে আলোচনায় সময়ক্ষেপণের অভিযোগে অভিযুক্ত করে বলছেন এটি নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটন সফরকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের কৌশল। এক জ্যেষ্ঠ ফিলিস্তিনি আলোচক বলেন, তারা কখনোই এ আলোচনায় আন্তরিক ছিল না। তিনি আরো দাবি করেন, ইসরায়েল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করতে চায়, যার অংশ হিসেবে রাফায় ‘মানবিক শহর’ স্থাপনের প্রস্তাব এসেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সম্প্রতি বলেছেন, তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন রাফায় একটি শিবির গড়ে তুলতে, যেখানে প্রথম ধাপে ৬ লাখ ও পরবর্তীতে গাজার পুরো ২১ লাখ মানুষকে স্থানান্তর করা হবে।
এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের কঠোর নিরাপত্তা যাচাইয়ের পর শিবিরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে, চাইলেই তারা বাইরে যেতে পারবে না। দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী ও শিক্ষাবিদেরা এই প্রস্তাবকে ‘বন্দিশিবিরের নকশা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বর্তমানে আলোচনার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত। ফিলিস্তিনি পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা আরো জোরালো হস্তক্ষেপ করে এবং ইসরায়েলকে বাস্তবসম্মত ছাড় দিতে বাধ্য করে। মধ্যস্থতাকারীরা সতর্ক করেছেন, মার্কিন হস্তক্ষেপ ছাড়া এ আলোচনা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে।
দোহায় অবস্থানরত কূটনীতিকরা বলছেন, এখনো সামান্য একটি জানালা খোলা আছে সমঝোতার জন্য, তবে অবস্থা খুবই নাজুক। একজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রক্রিয়া এখন একটা সুতার ওপর ঝুলছে। দ্রুত ও বড় ধরনের পরিবর্তন না এলে আমরা পুরোপুরি ভাঙনের পথে যাচ্ছি।