পতিত জমিকে কাজে লাগিয়ে সফল তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা শাকিল

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: ০৫:১০ পিএম, রোববার, ৩০ জানুয়ারী ২০২২ | ৩০৪

পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পিছনে ছুটবে, চাকরি করবে! চাকরি না করলে লেখাপড়া বৃথা এমন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন একজন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ (২০)।  শাকিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে চাকরির পিছনে না ঘুরে নিজেই গড়ে তুলেছেন ফার্মনেট.এশিয়া লিমিটেড-মিশ্র ফল ও সবজির প্রজেক্ট।

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের গমজানি গ্রামের শিক্ষিত যুবক কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ। শাকিল ওই গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে।   জানা যায়, ২০২০ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের  কৃষি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেন শাকিল আহমেদ। করোনায় ঘর বন্দি হয়ে দিশে হারা হয়ে পড়েন তিনি। এদিকে পড়াশোন শেষ। আরেক দিকে করোনা হানা দিয়েছে সারা বিশ্বে। দূরচিন্তায় পরেন শাকিল। ভাবতে থাকেন ঘর বন্দি সময়টা কিভাবে কাজে লাগানো যায়। তখন তার মাথায় আসলো আমি তো কৃষি বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি। কৃষকের সন্তান! সময়টা নষ্ট না করে বাবার জমিতে চাষাবাদ শুরু করি।

একপর্যায়ে নিজেই পৈতৃক ৪২ শতাংশ জমিতে শুরু করেন কোরিয়ান সবজি ‘স্কোয়াশ’ চাষ। মাত্র তিন মাসেই স্কোয়াশ বিক্রি করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ করেন। পরে ওই জমিতে তরমুজ, শসা ও বাঙ্গি একসঙ্গে আবাদ করেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করায় খুব ভালো ফলন হয়। আশপাশের গ্রাম, এমনকি টাঙ্গাইল শহর থেকেও ক্রেতারা জমিতে এসেই ফল কিনে নেন।

পরে তিনি ৮০ হাজার টাকার তরমুজ, ৭৫ হাজার টাকার শসা ও ২০ হাজার টাকার বাঙ্গি বিক্রি করেন। এতে তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ বাড়াতে থাকেন। এখন তিনি ৪২ শতাংশ জমিতে স্কোয়াশ, ৪০ শতাংশ জমিতে ক্যাপসিকাম, ৫০ শতাংশ জমিতে মিশ্র ফল (পেঁপে, তরমুজ ও বিদেশি ফল) এবং ১২০ শতাংশ জমিতে ব্রুকলি রেড ক্যাভেজ, বাঁধাকপি, টমেটো, লাল শাক ও কচু আবাদ করছেন।  নিজের অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে কৃষি প্রজেক্ট থেকে তিনি ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন। আশপাশের কয়েক গ্রামের শিক্ষিত বেকার যুবকরা আসছেন তার এ প্রজেক্ট পরিদর্শনে। তারাও চাকরির পেছনে না ছুটে এ ধরনের প্রজেক্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

  স্থানীয় যুবক সাইফুল ইসলাম বলেন, শাকিলের প্রজেক্ট দেখতে আসছি। জমিটা পতিত ছিলো পতিত জমিতে বিভিন্ন ফল সবজির চাষ করছে শাকিল। তার এ উদ্যোগ দেখে আমার ভালো লেগেছে। আমিও পতিত জমিতে শাক-সবজি চাষ করবো।

 জাকির মিয়া বলেন, শাকিলের সবজি আবাদ দেখতে আসছি। আমরা অনেক মুগ্ধ। আমাদের এই গ্রামে অনেক ছাত্র বেকার অবস্থায় থাকার কারণে শাকিল এমন একটি পদ্ধতি নিয়েছে। যে পদ্ধতির কারণে আমরা সবাই বিশেষ করে যুবক যারা আছি অনেক মুগ্ধ হয়েছি। আমরাও শাকিলের মতো পতিত জমিতে ফল ও সবজি চাষাবাদ করবো।

শাকিলের ফার্মে কাজ করা কৃষকরা বলেন, আমরা এখানে প্রথম থেকে কাজ করতেছি। এখানে বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি চাষাবাদ হচ্ছে। এখানে কাজ করে নিজের সংসার ভালোভাবে চলে। এখানে কাজ শিখে নিজেও চাষাবাদ শুরু করবো।

কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ জানান, গত বছর আমি বিদেশি সবজি স্কোয়াশ বিভিন্ন জাতের তরমুজ, শসা, মিশ্র ফসলের আবাদে সফল হওয়ার পরে আমি নতুন একটা উদ্যোগ নেই। সে উদ্যোগ ফার্মনেট এশিয়া। আমি বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক লাভবান হই। পতিত জমিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই প্রযুক্তি গুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে কাজ করছি। সারা বাংলাদেশের কৃষকদের নিয়ে কাজ করার জন্য ফার্মনেট এশিয়া স্টাটাপ খুলেছি। এই স্টাটাপের মাধ্যমে আমি এখানে প্রায় ১২৫ শতাংশ জায়গায় বিভিন্ন মিশ্র ফল ও সবজি চাষাবাদ করেছি। আমাদের টাঙ্গাইলে আগে কখনও হয়নি এমন বিদেশী ফল রকমেলন চাষ করেছি। সেটার ফল অনেক ভালো।  এই জমিটাতে আমি প্রায় দশ রকমের বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষাবাদ করছি। এখানে তিন কালারের তরমুজ আছে। একটা জমিতে পেঁপের বাগান করবো। পেঁপে গাছ হতে হতে কিভাবে দশ-বারোটা ফসল করে নেওয়া যায় এমটাই লক্ষ্য ছিল আমার। আমরা আরও তিন একর জায়গায় আছে সেখানে আমি বিদেশি ক্যাপসিকাাম, স্কোয়াশ ও শসার আবাদ করেছি। এখানে মোটামোটি সব গুলোতেই ফলন ভালো। এখন আমি চাই যে বাংলাদেশের যত বেকার যুবক আছে। যারা পড়াশোনার পাশাপাশি যদি এদিকে উদ্বুদ্ধ হয়। আমাদের ফার্মনেট এশিয়া সব সময় তাদের পাশে আছে। তাদের সমস্ত প্রকার সাপোর্টের মাধ্যমে আমরা সারা বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে কাজ করার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি।

শাকিলের বাবা আব্দুল করিম জানান, শাকিল যখন বিদেশি সবজি, ফল চাষ শুরু করলো, তখন গ্রামের অনেকেই ওকে পাগল বলতো। তাঁরা বলতেন, বিদেশি ফল, সবজি এ অঞ্চলে হবে না। আর শাকিল এখন বিদেশি ফল, সবজি আবাদ করে ঢাকায় বিক্রি করছে। এগুলো দেখে গ্রামের মানুষের ভুল ভেঙেছে। অনেক কৃষক এখন শাকিলের মতো বিদেশি ফল ও সবজি চাষে যুক্ত হচ্ছেন। কৃষিবিদ শাকিল আহমেদের এ সফলতায় খুশি এলাকাবাসীও। প্রতিদিনই আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষিত বেকার যুবকর ও কৃষকরা ছুটে আসছেন তার এ প্রজেক্ট দেখার জন্য। তারা শাকিল আহমেদের কাছ থেকে নিচ্ছেন বিভিন্ন পরামর্শ। তারা এ ধরণের প্রজেক্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

এ ব্যাপারে দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ প্রায় ১২০ শতাংশ জমিতে ১০ রকমের উচ্চমূল্যের শাক-সবজি পর্যায়ক্রমে চাষ করছেন। তার পাশাপাশি প্রায় ৫ একর জমিতে উচ্চমূল্যের বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ করেছেন। তার এই চাষাবাদ দেখে তরুণ সমাজ চাষাবাদে আগ্রহী ও সম্পৃক্ত হচ্ছে। এভাবে শিক্ষিত তরুণ সমাজ কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হলে অদূরভবিষৎতে বাংলাদেশ কৃষিতে আরো সমৃদ্ধ হবে। শাকিলের এই কাজে দেলদুয়ার কৃষি অফিস সব সময় পাশে আছে। শাকিলের মত আরো কোন তরুণ আধুনিক চাষাবাদে আগ্রহী হলে আমরা তাদের পাশে থাকবো।