দাড়ি কাটা, দাড়ি ছাঁটা: কিছু ভ্রান্তি, কিছু বিভ্রান্তি

মাহবুবুল হাসান আরেফী
প্রকাশিত: ০৮:০৫ পিএম, সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০১৭ | ৫৯১৩

দাড়ি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এটি সব নবীর সুন্নত। সব নবীরই দাড়ি ছিল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দশটি বিষয় ফিতরতের অন্তরর্ভুক্ত। মোচ ছোট করা, দাড়ি লম্বা করা… (মুসলিম, হাদীস নং-২৬৩)

হাদীসে উল্লেখিত এই ফিতরতের অর্থ কি? উলামায়ে কেরাম এর ব্যাখ্যায় বলেছেন ফিতরত হচ্ছে সুন্নাহ অর্থাৎ সব নবীর সুন্নাহ, যা আকড়ে ধরার জন্য আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে। (শরহু মুসলিম, নভভী: ৩/১৪৮; মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার ৪/১৫৫)

একজন মুসলমান দাড়ি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য উপরোক্ত হাদীসটিই যথেষ্ট। দাড়ি সব শরীয়তের বিধান, সব নবীর সুন্নাহ। কোনো মুসলমান এটা জানার পর কি দাড়ি ছাঁটাই করতে কিংবা মুণ্ডাতে পারে?

নবীজী থেকে দাড়ি রাখার সুস্পষ্ট আদেশও বর্ণিত আছে। হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা কর। দাড়ি বাড়াও এবং মোচ ছোট কর। (বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯২; মুসলিম, হাদীস নং-২৬২)

হায়! নবীজী সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে মুশিরকদের বিরোধিতা করতে বলেছেন, সেখানে আমরা তাদের কালচার এবং ফ্যাশনকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। শুধু তাই নয়, এমন গর্হিত কাজের পক্ষে আমরা সাফাই পেশ করছি যে, এটা তো সুন্নত; ফরজ বা ওয়াজিব তো নয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

তাদের কথা অনুযায়ী বাস্তবে যদি এটা শুধু সুন্নতই হতো, তবুও কি একজন প্রকৃত মুসলমানের পক্ষে একথা বলা সম্ভব যে, এটা তো সুন্নত তাই পালন করা জরূরী নয়! আর সমস্ত নবীদের সর্বসম্মতি সুন্নতের বিষয়টি তো আরো গুরুত্বপূর্ণ।

দাড়ি সুন্নত, এটা ঠিক। কিন্তু সুন্নত শব্দের অর্থ কি তা তো জানতে হবে। এক হচ্ছে ফিক্বহী সুন্নত যা ফরজ ওয়াজিবের বিপরীত। আরেকটি হচ্ছে শাব্দিক অর্থে সুন্নত কিন্ত ফিক্বহী দৃষ্টিতে তা ফরজ কিংবা ওয়াজিবও হতে পারে।

দাড়ি সমস্ত নবীদের সুন্নত অর্থাৎ তাদের রীতি তাদের অভ্যাস এই অর্থে সুন্নত বলা হয়েছে। কিন্তু ফিক্বহী দৃষ্টিতে তা ওয়াজিব। কেননা অসংখ্য হাদীসে দাড়ি রাখার আদেশ করা হয়েছে তাই এটা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে দাড়ি লম্বা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

انْهَكُوا الشَّوَارِبَ وَأَعْفُوا اللِّحَى
(বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯৩; মুসলিম, হাদীস নং-২৬০)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে,
وَأَوْفُوا اللِّحَى
(বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯২; মুসলিম, হাদীস নং-২৬২০)

এসকল বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে দাড়ি লম্বা করার আদেশ দেয়া হয়েছে।

উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে দাড়ি রাখার গুরুত্ব সুস্পষ্ট। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি দাড়ি লম্বা হতেই থাকবে? দাড়ি বিলকুল কাটা যাবে না। তখন তো অসুন্দর দেখা যেতে পারে।

না। বিষয়টি এমন নয়। সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস নং-৫৮৯২ এর শেষে উল্লেখ হয়েছে, হযরত ইবনে উমর রা. যখন হজ্জ বা উমরা করতেন, এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কেটে ফেলতেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা.ও এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কাটতেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের উসতায ইবনে আবী শাইবাহ রহ. এর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মুসান্নাফ’ (১৩/১১২) এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ”হযরত অাবু হুরায়রা রা. দাড়ি মুষ্ঠিবদ্ধ করতেন অত:পর এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়ি কেটে ফেলতেন।

এছাড়াও ক্বাতাদাহ, হাসান বাসারী, ইবনে সিরীন, আতা, তাউস, ক্বাসিম প্রমুখ তাবেয়ীগণ এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কাটতেন, এ মর্মে আছার বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ: ১৩/১১২-১১৩

শুরুতে উল্লেখিত বিভিন্ন হাদীসে আমরা দাড়ি লম্বা করার আদেশ পেয়েছি কিন্তু এর বিপরিত সাহাবা ও তাবেয়ীনদের আমল পেলাম, তারা এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কেটেছেন। যেমন ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা রা. এর আমল।

সাহাবায়ে কেরাম রা. নবীজীর আদেশের বিপরীত আমল করবেন এটা কল্পনাও করা যায় না। ইবনে উমর রা. তো নবীজীর এতো বেশি অনুসরণ করতেন যে, কেউ দেখলে মনে হতে পারে লোকটি কি মাজনুন? (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা: ৩/২১৩)
নিশ্চয় তারা নবীজী থেকে এই মর্মে কোনো নির্দেশনা পেয়েছেন যে, একমুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কাটা যাবে। 

প্রশ্ন হলো সেই নির্দেশনাটি কোথায় বা নবীজী দাড়ি কেটেছেন এমর্মে কোনো হাদীস থাকলে সেটি কোথায়? হ্যাঁ, আছে। তিরমিযি শরীফে (হাদীস নং ২৭৬২, ২৯১২) হযরত আমর ইবনুল আস রা. এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দু’দিকে তাঁর দাড়ি কাটতেন।

সনদের বিচারে হাদীসটি দুর্বল। ইমাম তিরিমিযি রহ. হাযা হাদীসুন গারীবুন’ বলে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে এতে কোনো সমস্যা নেই। হাদীসটি ‘শাওয়াহিদে মা’নওয়ী’ (উলূমুল হাদীসের একটি পরিভাষা) এর কারণে গ্রহণযোগ্য।

বুঝা গেল দাড়ি লম্বা করার যে বিধান এসেছে এর অর্থ এই নয় যে দাড়ি লম্বা হতেই থাকবে। বিলকুল কাটা যাবে না। বরং নির্দিষ্ট পরিমাণ হলে কাটা যাবে। বিষয়টি ইমাম তাবারী রহ. সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন-

“হযরত আমর ইবনুল আস রা. এর হাদীসে যে নবীজীর দাড়ি কাটার কথা বর্ণিত হয়েছে এটা اعفوا اللحى অর্থাৎ দাড়ি লম্বা করার হাদীসের বিরোধী নয়। কেননা নিষেধ তো হলো আজমীদের মতো দাড়ি মুণ্ডানো অথবা কবুতরের লেজের মতো রাখা। আর اعفوا اللحى এর মধ্যে ই’ফা এর অর্থ হলো, দাড়ি বাড়ানো যা অন্য বর্ণনায় এসেছে, অগ্রভাগ থেকে কিছু (অর্থাৎ একমুষ্টির অতিরিক্ত কিছু) কেটে ফেলা। এটা তো কোনো ক্রমেই মুণ্ডানো হতে পারে না।” (মিরক্বাতুল মাফাতীহ: ৮/২৮৫)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল:
ক. দাড়ি লম্বা করতে হবে এটাই নবীজীর আদেশ।
খ. এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কাটা যাবে।
গ. দাড়ি মুণ্ডানো সম্পূর্ণ হারাম। এটা নবীজীর আদেশের বিরোধী।
ঘ. দাড়ি ছাঁটাই করে এক মুষ্ঠির কম রাখাও না জায়েয।

আল্লামা মাহমুদ খাত্তাব রহ. তার আবু দাউদ শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্য গ্রন্থ আল মানুহালুল আযবিল মারূদ গ্রন্থে (১/১৮৬) দাড়ি লম্বা করার আদেশ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করে বলেন, একারণেই সকল মুজতাহিদ, আইম্মায়ে মুসলিমীন যেমন ইমাম আবু হানীফা, মালেক, শাফেয়ী, আহমদ ও অন্যান্যদের মতে দাড়ি মুণ্ডানো হারাম।

বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফয়জুল বারী’ এর টিকায় (৬/৯৯) এসেছে-
“এক মুষ্ঠির কম দাড়ি কাটা হারাম। এতে সকল ইমামদের ইজমা রয়েছে।”

মাহবুবুল হাসান আরেফী
মুহাদ্দিস, লেখক, গবেষক।