শিক্ষায় নারী জাগরণের গ্রাম টাঙ্গাইলের সাহাপুর

নুর আলম,গোপালপুর
প্রকাশিত: ০১:১৮ পিএম, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৯ | ৪১৮

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার এক অজপাড়া গ্রামের নাম সাহাপুর। শিক্ষায় নারীজাগরণের ছোট্র এ গ্রামটি এখন দেশের রোল মডেল।

১৯৪৭ সালের দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাহারা এ গ্রাম থেকে ভারতে পারি জমালেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদিক্ষা সযত্নে লালণ করে চলছে গ্রামবাসি।

উপজেলা শহর থেকে ছয় মাইল দূরে নির্ভৃত এ সাহাপুর গ্রামের প্রায় সবাই নিম্ন মধ্যবিত্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত আছেন প্রায় জনা পঞ্চাশেক। আর এসব শিকক্ষগণই মূলত নারী শিক্ষার নেপথ্যে বিল্পব ঘটিয়েছেন।

মাত্র একটি ছেলে উচ্চ শিক্ষায় বর্তমানে পড়াশোনা করলেও এ গ্রামের ৬জন মেয়ে মেডিক্যালে এবং ১১ জন মেয়ে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যাালয়ে উচ্চশিক্ষায় পড়াশোনা করছেন।

এ গ্রামের সন্তান ছাকিবুন্নাহার বণ্যা ত্রিশাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথমস্থান অধিকার করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পান।

গ্রামের নিলোফার ইয়াসমিন ময়মনসিংহ মেডিক্যালে, মাহমিনা মীম ঢাকা মেডিক্যালে, দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত সুচিত্রা ধর রাজশাহী মেডিক্যালে, খুলনা বেসরকারি মেডিক্যালে সুরাইয়া সুলতানা প্রমি, রংপুর মেডিক্যালে আখিঁ আখতার।

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চীনে পিএইচডি করছেন জান্নাতুল নাহার লিজা। বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন আমিনা তালুকদার রিতু।

নিশাত তালুকদার এবং হোসনেআরা রিংকু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তানিয়া ইয়াসমীন তণু, জান্নাতুল মাওয়া, কামরুন্নাহার পাঁপড়ী এবং সেতু তালুকদারসহ এক ডজন মেয়ে জাহাঙ্গীর নগর, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।

আর গ্রামের একমাত্র ছেলে শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান তালুকদার পড়াশোনা করেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে।

গ্রামের দুইজন মেয়ে বাংলাদেশ পুলিশে, ১২জন নার্সিংয়ে এবং ১০ জন মেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত। এ গ্রামে শিক্ষার হার ১০০%।

অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক লুৎফর রহমান মনির বলেন, সুষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য উনবিংশ শতাব্দীতে সাহাপুর গ্রামে হিন্দু সাহারা টোল প্রতিষ্ঠা করেন। টোলে শিক্ষকতা করতেন মা রোকেয়া খাতুন। বিনা বেতনে তিনি দীর্ঘদিন গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়ান। সেখান থেকেই এ গ্রামে নারী শিক্ষার পথযাত্রা।

তিনি আরোও জানান, সকলের অনুস্মরনীয় ছিলেন এ গ্রামের প্রথম স্কুল শিক্ষক আব্দুর রহিম। পরবর্তীতে রহিম স্যারকেই অনুস্বরণ করে সাহাপুর গ্রাম কালক্রমে পরিণত হয় শিক্ষকের গ্রামে। বর্তমানে ৪৯ জন শিক্ষকতায় নিয়োজিত। ষাটের দশকে সাহাপুর প্রাইমারী স্কুলটি সরকারিকরণ করা হয়। গ্রামের এ প্রাইমারী স্কুল থেকেই হাতেখড়ি নিয়ে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন।

প্রবীণ স্কুল শিক্ষক আব্দুর সাত্তার জানান, তুলনামূলকভাবে ছেলে সন্তানদের বাড়তি আগ্রহ ব্যবসাবাণিজ্য, বিদেশগমণ, ঘরগৃহস্থালি এবং রাজনীতির প্রতি। গৃহিণীরা মেয়ে সন্তানদের যতোটা সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, ছেলেদের ক্ষেত্রে ততোটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এজন্যই গ্রামে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে শিক্ষায় বৈষম্য।

স্কুল শিক্ষক এমএ মাসুদ বলেন, বর্তমানে গ্রামে ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে বেশি। সাহাপুর গ্রামে প্রাচীনকাল থেকেই নারী শিক্ষার বাড়তি পরিবেশ এবং অভিভাবক সচেতনতার জন্য এখানে নারীদের জয়জয়কার।

এবিষয়ে গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিকাশ বিশ্বাস জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি গ্রামাঞ্চলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা শিক্ষায় অগ্রগামী খবরটি অনেক উৎসাহব্যঞ্জক এবং অনুপ্রেরণাময়। সারাদেশের জন্য নারী শিক্ষায় সাফল্য লাভের দিকটি বিবেচনায় সাহাপুর গ্রামটি রোল মডেল হতে পারে।