শ্রমিকের টাকা ১০ এজেন্সির পেটে

আলোকিতপ্রজন্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭:১০ পিএম, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০১৯ | ২৭১

জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর খরচ বা অভিবাসন ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বেঁধে দিয়েছে জনপ্রতি ৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকা। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া নিয়োগানুমতিপত্র-গুলোতে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি কোনো শ্রমিকের কাছ থেকে ওই পরিমাণ টাকার বেশি নিতে পারবে না এবং ওই টাকা নিতে হবে চেক/ব্যাংক ড্রাফট/পে অর্ডারের মাধ্যমে। কিন্তু মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যত শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়েছে, কেউ-ই ওই টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানায়নি। মালয়েশিয়ায় ১০ দিনের সফরে যে ৭৮ শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪২ জনই জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে এখানে এসেছে এবং একেকজন সর্বনিম্ন আড়াই লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা দালালের মাধ্যমে এজেন্সিকে নগদ দিয়েছে। এই হিসাবে একেকজন শ্রমিককে গড়ে খরচ করতে হয়েছে তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকার মতো।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কোন এজেন্সির মাধ্যমে কত শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গেছে, তার সরকারি তালিকা সংগ্রহ করেছে কালের কণ্ঠ; বিশ্লেষণ করেছে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি চাহিদাপত্র অনুমোদনের সরকারি নথি। অনুমোদিত চাহিদাপত্র থেকে দুই বছরে পাঠানো দুই লাখ ৭৩ হাজার ৪৭৫ জন কর্মীর ডাটা সংগ্রহ করে সব তথ্য একটি ডাটা বেইসে সংকলন করেছে কালের কণ্ঠ। সেখানে কোন কর্মী কাদের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছে এবং কে কোথায় নিয়োগ পেয়েছে—সব কিছুই রয়েছে।

তবে বিএমইটির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ওই দুই বছরে মালয়েশিয়ায় যাওয়া কর্মীর সংখ্যা দুই লাখ ৭৫ হাজার ৯১৫।

সেই উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ওই দুই বছরে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৪৭৫ জন শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গেছে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। গড় অভিবাসন ব্যয় তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকা ধরলে শ্রমিক বাণিজ্যে ৯ হাজার ২১৬ কোটি ১০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছে। সরকার নির্ধারিত টাকা নিলে লেনদেন হতো ৯১৮ কোটি ১৯ লাখ ২৩ হাজার ১২৪ টাকা। অর্থাৎ এজেন্সিগুলো অতিরিক্ত নিয়েছে আট হাজার ২৯৭ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৬ টাকা। অবশ্য সংশ্লিষ্ট জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তারা সরকারের বেঁধে দেওয়া এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করেই নিয়েছে, তার বেশি নয়। কিন্তু তাদের এই দাবি সঠিক নয় বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে দুই দেশের সরকার নির্ধারিত শ্রমিকপ্রতি অভিবাসন ব্যয় ৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকা। একপর্যায়ে এজেন্সিগুলো এই ব্যয় বাড়িয়ে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করার দাবি তুললেও তা দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি অনুমোদন করেনি। তাদের ওই দাবি সঠিক ধরে নিলেও শ্রমিকদের কাছ থেকে এজেন্সিগুলো অতিরিক্ত নিয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু শ্রমিকদের প্রাপ্তি শূন্য। তারা এত টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েও হয়েছে প্রতারিত, বঞ্চিত। তাদের পরিবার-পরিজন হয়েছে সর্বস্বান্ত।

সিন্ডিকেটের এসব ঘটনা নিয়ে দুই দেশেই সরকারি তদন্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় দোষীদের বিচার চলছে; অভিযুক্তদের অনেকেই পালিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে, যেখানকার লাখো শ্রমিক ভুক্তভোগী, সেখানকার মন্ত্রণালয় বা দুর্নীতি দমন কমিশন কারো তদন্তই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আদালত দোষীদের শনাক্ত করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের রুল জারি করলেও কারো বিচার হয়নি।

মালয়েশিয়ায় জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো সিন্ডিকেটের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির একটি আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। ওই দুই বছরে ৩৮ হাজার ৫৬৬ জন কর্মী পাঠিয়ে শীর্ষে আছে আইএসএমটি।

এর পরই বেশি কর্মী পাঠিয়েছে রুহুল আমিন স্বপনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল—৩৮ হাজার ৪৩৮ জন। ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড কর্মী পাঠিয়েছে ৩৩ হাজার ২৯১ জন। আল ইসলাম ওভারসিসের ম্যানেজিং পার্টনার জয়নাল আবেদীন জাফর পাঠিয়েছেন ২৮ হাজার ৪০৬ জন। আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের  মালিক রুহুল আমিন পাঠিয়েছেন ৩১ হাজার ১৯২ জন; সানজারি ইন্টারন্যাশনাল ২২ হাজার ৫৬৯ জন; মেসার্স রাব্বি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী  মোহাম্মদ বশির পাঠিয়েছেন ২১ হাজার ৭২৯ জন, ক্যারিয়ার ওভারসিস কনসালট্যান্স লিমিটেডের পরিচালক এ এস এম খাইরুল আমিন ১৮ হাজার ৭৩১ জন;  মেসার্স প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা পাঠিয়েছেন ২২ হাজার ৫৩৪ জন এবং প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস পাঠিয়েছে ১৮ হাজার ১৯ জন কর্মী।

‘দিয়েছি তিন লাখ, হলফনামায় লিখে নিয়েছে ৩৩,৫৭৫’ মো. কাউসার ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় আসেন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে। গত ১০ অক্টোবর কুয়ালালামপুরের মসজিদ ইন্ডিয়ায় দেখা হলে তিনি বলেন, ‘তিন লাখ টাকা দিলেও ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত দিতে হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকার বেশি দিইনি।’ একই দিন কোতরায়া এলাকায় কথা হয় রাজিবুল ইসলাম ও শফিকুল আলম নামে আরো দুই শ্রমিকের সঙ্গে। তাঁরা দুজনও ক্যাথারসিসকে তিন লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা জানান।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামের দালালকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার ক্যাথারসিসের ম্যানেজার জিয়া ইসলামের মাধ্যমে আড়াই লাখ টাকা জমা দিই; কিন্তু চাইলেও কোনো রসিদ দেয়নি ওরা। এ ছাড়া দালালের হাতেও দিয়েছিলাম এক লাখ ১০ হাজার টাকা।’

শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, মালয়েশিয়ায় যত শ্রমিক পাঠিয়েছে, সবার কাছ থেকেই ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্পে ‘৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকার বেশি দিইনি’ হলফনামা সই করিয়ে নেয় ক্যাথারসিস। এমন একাধিক হলফনামা এই প্রতিবেদকের সংগ্রহে আছে।

শ্রমিকপ্রতি গড় অভিবাসন ব্যয় তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকা ধরলে ক্যাথারসিস ৩৮ হাজার ৪৩৮ জন শ্রমিকের কাছ থেকে বেশি আদায় করেছে এক হাজার ২৯৫ কোটি ৩৬ লাখ ছয় হাজার টাকা। আর মালিকপক্ষের দাবি এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করে ধরলে বাড়তি আদায় দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি টাকা ৮০ হাজার টাকা।

ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের অফিস ঢাকার বনানীতে। মালিকের নাম রুহুল আমিন স্বপন। তিনি একসময় জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত ১৯ জুলাই মোবাইল ফোনে রুহুল আমিন স্বপন বলেন, ‘আমরা সরকারের বেঁধে দেওয়া টাকাই নিয়েছি, তার বেশি না।’

‘আপনার ম্যানেজার জিয়া ইসলাম (এখন তিনি ক্যাথারসিসে নেই) তো শ্রমিকদের আড়াই লাখ টাকা করে ফেরত দিয়েছেন’, জানালে রুহুল আমিন সেটা অস্বীকার করেন। ‘আমাদের হাতে প্রমাণ আছে’ জানালে তিনি বলেন, ‘আমি বিদেশে আছি। দেশে ফিরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।’

২০১৮ সালের অক্টোবরে ৬৩ জন শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় পাঠায় প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস। ১১ অক্টোবর কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে পৌঁছলে তাদের গ্রহণ করতে নিয়োগদাতা কম্পানি সুপারম্যাক্সের কোনো প্রতিনিধি আসেননি। বিমানবন্দরেই অভুক্ত অবস্থায় কাটানোর পর ১৩ অক্টোবর দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে। এদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, এই প্রতারণার ঘটনা জানাজানি ও হৈচৈ হলে রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃপক্ষ আড়াই লাখ টাকা করে ফেরত দেয়। টাকা ফেরত পাওয়া একজন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার মো. কামাল মিয়ার ছেলে মো. সামিউল ইসলাম। তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানীয়  দালাল আব্দুর রাজ্জাকের মাধ্যমে জমা দিয়েছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিতে। কুয়ালালামপুরে সামিউল গত ১৮ জুলাই এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দেশে ফেরত আসার পর ঢাকার ক্যাথারসিস অফিসে ডেকে নিয়ে বিএমইটির স্মার্ট কার্ড রেখে দিয়ে আড়াই লাখ টাকা নগদ ফেরত দেয়।’

আড়াই লাখ টাকা করে আরো ফেরত পান কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেনদী গ্রামের মো. জালাল উদ্দিনের ছেলে মো. নাসিরউদ্দিন ও মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার দাড়িয়াপুর গ্রামের মো. মোখলেস।

আড়াই লাখ টাকা শ্রমিকদের ফেরত দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের ওই সময়কার ব্যবস্থাপক জিয়া ইসলাম ১৯ জুলাই কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যাথারসিসের মাধ্যমে শ্রমিকরা টাকা জমা দিলেও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হয়েছিল প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে। বিমানবন্দর থেকে ফেরত আসার পর বেশ কয়েকজন শ্রমিককে আড়াই লাখ টাকা করে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ শ্রমিকরা তিন লাখ-সাড়ে তিন লাখ-চার লাখ টাকা করেও দিয়েছে—জানালে জিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিল; সেটাই আমরা ফেরত দিয়েছি। বাকি টাকা স্থানীয় দালাল হয়তো নিয়েছে।’

মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে গত ১২ অক্টোবর প্যাসেজের মালিক আরিফ আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার নির্ধারিত টাকা নিয়েই কর্মী পাঠিয়েছি।’ আর শ্রমিকদের ফিরে আসার ঘটনা তাঁর ‘নলেজে’ নেই বলে দাবি করেন।

প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের মালিক গোলাম মোস্তফার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু ১০ এজেন্সিই কর্মী পাঠাইনি। আমাদের মাধ্যমেও অনেক এজেন্সি কর্মী পাঠিয়েছে। ওই কর্মীরা সবাই ভালো আছে। দু-একটি অঘটন হয়তো ঘটতে পারে। আমাদের জানালে ব্যবস্থা নিতে পারব। আর সরকারের নির্ধারিত টাকায়ই আমরা কর্মী পাঠিয়েছি।’

রাব্বি ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. বশির বলেন, ‘৪০ হাজার টাকায় কর্মী পাঠানো যায় না। তবে সরকারের সঙ্গে আমাদের পরে একটি সমঝোতা হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় কর্মী পাঠানোর। পরবর্তী সময়ে সেই টাকায় লোক পাঠাই।’

বিষয়টি নিয়ে বরাবরই সরব বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী। তিনি ওই ১০ এজেন্সি সম্পর্কে বলেন, এই সিন্ডিকেট সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে বেশি টাকা নিত বলে অভিযোগ তো আছেই; আর কর্মীপ্রতি পাঁচ হাজার রিঙ্গিত, বাংলাদেশি এক লাখ টাকা দেওয়া হতো মালয়েশিয়ার দাতুক সেরি আমিন সিন্ডিকেটকে। বাকি টাকা পেত এজেন্সিসহ বিভিন্ন সেক্টরের লোকজন।’

বায়রার বর্তমান মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘সরকার ১৬টি দেশের জন্য অভিবাসন ব্যয়ের তালিকা করে দিয়েছে। সেখানে মালয়েশিয়ার জন্য এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই টাকায়ই সম্ভবত মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হয়েছে।’

এর চেয়েও বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেই বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না, তবে আগামী দিনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কম টাকায় হয়রানি ছাড়াই দক্ষ কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, সেখানে কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা বলে কিছু থাকবে না।’

অবশ্য বাড়তি যে টাকা নেওয়া হয়, তার সবটাই যে এজেন্সির পকেটে যায়, তা নয়। মালয়েশিয়ায় পাঠানো শ্রমিকদের থেকে নেওয়া শত শত কোটি টাকা বণ্টনের কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। খাতসংশ্লিষ্ট অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে এবং এসংক্রান্ত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন থেকে একটি প্রাথমিক চিত্র পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী, শ্রমিকপ্রতি নেওয়া বাড়তি টাকা থেকে এক লাখ দিতে হয় মালয়েশীয় নিয়োগদাতাসহ সে দেশের সিন্ডিকেটকে। ৫০-৬০ হাজার টাকা নিয়ে যায় মাঠের দালালরা। ৫০-৬০ হাজার টাকা চলে যায় যাতায়াত, আনুষঙ্গিক খরচ ও সরকারি অফিসে দেওয়া ঘুষে। বাকি এক লাখের মতো মুনাফা থাকে এজেন্সির।

মালয়েশিয়ায় বিচার হয়, বাংলাদেশে হয় না

বাংলাদেশে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সি আছে এক হাজারের বেশি। কিন্তু মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দখলে নিতে দুই দেশের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট জড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত কাজ পায় বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি, যা ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট হিসেবেই পরিচিত জনশক্তি সেক্টরে। জিটুজি প্লাস চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী কর্মী নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া হয় অনলাইনে। এ কাজের জন্য সিনারফ্ল্যাক্স নামে একটি কোম্পানিকে নিয়োগ দেয় মালয়েশিয়া সরকার। সিনারফ্ল্যাক্সের মালিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান নাগরিক দাতুক সেরি আব্দুল বিন আমিন নূর। এই সিনারফ্ল্যাক্সের সঙ্গে বাংলাদেশের ১০টি এজেন্সি মিলে তৈরি করে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট আর সিন্ডিকেটের গডফাদারের ভূমিকা পালন করেন দাতুক আমিন। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের স্ত্রী ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের ওপর মহলকে ম্যানেজ করেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কুক্ষিগত করেন তিনি। কিন্তু সিন্ডিকেট ও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়ান সরকার এবং পুরো ঘটনার তদন্তে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রসচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারার কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আর পুরো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন মালয়েশিয়ার সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশি-মালয়েশিয়ান নাগরিক আমিন নূর। এই তথ্যগুলো মালয়েশিয়ার স্টার অনলাইনে ছাপা হয়েছে।

এদিকে শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে একটি মামলা হয় (রিট পিটিশন মামলা নম্বর-১৩২৮৭/২০১৮)। অভিযোগের বিষয়টি তদন্তে আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। গত ২৯ অক্টোবর উচ্চ আদালত নির্দেশনা দেন যে তিন মাসের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে তা প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে। এ ছাড়া মাত্র ১০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানো নিয়ন্ত্রণ এবং এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ওই ১০টি এজেন্সির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফজলুর রহমানকে প্রধান করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি তিন মাসে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। কমিটির সর্বশেষ সভা হয় গত ৩১ মার্চ। ওই দিনই ফজলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে, তাই এখন কিছুই বলা যাবে না।

পাশাপাশি অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহ বিষয়টি অনুসন্ধান করছেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে সিন্ডিকেটের দুর্নীতির বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। কমিশনের অনুমতি ছাড়া মিডিয়ায় তিনি বক্তব্য দিতে পারেন না বলে জানান।

‘চিঠি দিয়ে সরকার বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু দুই দেশের কমিটি সেটা অনুমোদন করেনি। পরে আর বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়টিও সরকারি সংস্থাগুলো তদারক করেনি। এ কারণে তারা পার পেয়ে গেছে কি না’—এ প্রশ্ন রাখলে রামরুর চেয়ারপারসন ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘উভয় দেশের চুক্তির আলোকেই অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেটা পুনর্নির্ধারণ করতে হলে উভয় দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকেই নির্ধারণ হওয়ার কথা। সেটা না করে একতরফাভাবে নতুন অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করাটা অবশ্যই বেআইনি।’

তিনি আরো বলেন, এ ধরনের অপরাধ করলে শুধু লাইসেন্স বাতিল হওয়াই সব কিছু নয়, ওই সব এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এই সিন্ডিকেটের অনিয়ম সম্পর্কে অবহিত আছেন জানিয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘আগে যা হওয়ার হয়েছে, আমার সময় কোনো ধরনের সিন্ডিকেট আর দুর্নীতি চলবে না। সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক, অভিবাসীদের নিয়ে প্রতারণা করলে ছাড় নয়।

সুত্রঃ কালের কন্ঠ