দুই দফায় শত শত ঘর দিলেও আমার ভাগ্যে জোটেনি

স্টার্ফ রিপোটার
প্রকাশিত: ১১:০২ এএম, শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর ২০২১ | ৩৩২

এক বছর আগে শুনছি যাদের বাড়ি ঘর নাই, প্রধানমন্ত্রী তাদের ঘর দিবো। কথাটি শোনার পর অনেক আশায় ছিলাম। আমাগো যখন বাড়ি ঘর নাই তাহলে আমরা একটা পাবো। সেই আশা বাস্তবায়ন করার জন্য মেম্বার চেয়ারম্যানের পিছনে মাসের পর মাস ছুটেছি। তালিকায়ও আমার নাম ছিলো। কিন্তু আজও পর্যন্ত আমাগো ভাগ্যে কোন একটি ঘর জোটেনি। ভাঙা জুপড়ি ঘরেই থাকতে হচ্ছে। বৃষ্টি আসলেই পানি পড়ে। এ অবস্থা দেখে কর্মকর্তারা ছবি তুলে নিয়ে গেছে তাও ঘর পেলাম না। কান্না জড়িত কণ্ঠে এভাবে কথা গুলো বলছিলেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলা গালা ইউনিয়নের ভাটাচান্দা গ্রামের মো. ছালামের স্ত্রী রাহানা বেগম। তার স্বামী খেলনা ফেরি করে বিক্রি করেন। তারা ওই গ্রামের মৃত হাতেম আলীর বাড়িতে প্রায় দুই যুগ যাবত আশ্রয় নিয়েছেন। 

২২ বছর আগে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা থেকে সদর উপজেলার ভাটচান্দা গ্রামে বৈশাখী মেলায় খেলনা বিক্রি করতে আসেন মো. ছালাম ও তার স্ত্রী রাহানা বেগম। তাদের বসত ভিটা না থাকায় মেলা শেষে কয়েক দিন পাশ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় আশ্রয় নেন। এ অবস্থা দেখে ওই গ্রামের হাতেম আলী ছালাম দম্পতিকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেয়। ছালাম যা আয় করেন তা দিয়ে তাদের খাওয়ার টাকায় হয় না। তাই দীর্ঘ দিনেও তাদের নিজস্ব কোন ঠিকানা হয়নি। করোনাকালে তারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। আশেপাশের লোকজন মিলে তাদের খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। একটি ঘরের জন্য তারা অনেক আকুতিমিনতি করছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের তালিকায় তাদের নাম আসেনি। 

রাহানা বেগমের অভিযোগ, তাদের তালিকায় নাম ঠিলো। চাহিদা মতো ঘুষ না দেয়ায় তাদের ভাগ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরও জোটেনি। একটি ঘরের জন্য মেম্বার চেয়াম্যানদের ধারে ধারে ঘুরছে। তাতেও কোন কাজ হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করেন। দিনে অন্যের ঘরে আশ্রয় নিলেও রাতে ঘুমের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথে তারা ভিজে যায়। যে কোন মুহুর্তে বাতাসে ঘরটি উড়ে যেতে পারে। 

মো. ছালাম বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ও হাটবাজারে খেলনা বিক্রি করে কোন রকম তাদের সংসার চলে। তাদের একটি ছেলে জায়গা জমি না থাকায় বিয়ে করে কয়েক মাস আগে শ্বশুরবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন। ছালাম ও রাহানা দম্পতির জন্য এক সরকারি ঘরের জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা দেখা যায়, মৃত হাতেম আলীর চার শতাংশ বাড়ির উত্তর পাশে তাদের বসবাসের ঘর। দক্ষিণ-পূর্ব কর্ণারে ছালামের জরাজীর্ণ ঘর। পাশেই কাপড়ের ছাউনিতে তার ছেলে বসবাস করতেন। বৃষ্টি মৌসুম শুরু হওয়ার পর সে শ্বশুরবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন। সব মিলে দুটি পরিবার গাদাগাদি করে বসবাস করে। ছালামের জরাজীর্ণ ঘরের ভিতর থেকে বাহিরের সবই দেখা যায়। 

জানতে চাইলে কান্না জড়িত কণ্ঠে রাহানা বেগম বলেন, কে দিবো আমাগো ঘর। ঘরের আশায় মেম্বার চেয়ারম্যানদের পিছনে প্রায় এক বছর ঘুরছি। কোন লাভ হয়নি। ঘর দেয়ার আশ্বাসে গালা ভূমি অফিসের ওমেদার লুৎফর পাঁচ হাজার টাকা দাবি করছিলো। কিন্তু তাকে চার হাজার টাকাও দিয়েছিলাম। কিন্তু তার চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারায় সেই ঘর ভাগ্যে জোটেনি। ভাবছিলাম মৃত্যুর আগে ভাল ঘরে বসবাস করতে পারবো। কিন্তু তারা আশা দিলেও কোন লাভ হয়নি। জরাজীর্ণ ঘরই আমার এক মাত্র ভরসা। মানুষ ঘরে নিচিন্তায় ঘুমালেও আমি স্বামীর সাথে চিন্তা মাথায় নিয়েই ঘুম পারতে হয়। কখন বুঝি ঘর মাথায় পড়বে। একটি ঘর হলে নিশ্চিন্তে শান্তিতে স্বামী নিয়ে ঘুমাতে পারতাম। 

মৃত হাতেম আলীর স্ত্রী জায়দা বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রী বিনামূল্যে ঘর দিবো এই খবরে এক বছর আগে থেকে ছালাম ও তার স্ত্রী মেম্বার সোরমান ও  চেয়ারম্যান রাজকুমারের ধারে ধারে ঘুরেছে। যারা ঘরের তালিকা করেছে তারা যদি সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করতো তাহলে প্রথমেই ছালাম ঘর পেতো। ঘর বরাদ্দে তালিকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অবহেলার কারণে ছালাম ঘর পায়নি। ছালামের মতো মানুষ ঘর পায়নি এটা কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা। ঘরের জন্য প্রতিবেশি লুৎফর টাকাও নিয়েছিলো। কিন্তু টাকা কম দেয়ায় সে তাদের ভাগ্যে ঘর জুটেনি। প্রধানমন্ত্রীর ঘর পেয়েছে সামর্থবানরা। 

প্রতিবেশি রুবেল মিয়া বলেন, কত মানুষ ঘর পেলো। যাদের সামর্থ আছে তারাও ঘর পেয়েছে। তবে সামর্থহীন ছালাম ঘর পায়নি এটা খুবই দুঃখজনক। যাদের জন্য ঘর বরাদ্দ এসেছে তারাই ঘর থেকে বঞ্চিত। বিষয়টি নিয়ে এলাকার মাতাব্বররা মেম্বার চেয়ারম্যান সাথে একাধিকবার আলোচনা করলেও কোন সুরাহা হয়নি। যে কোনভাবে ছালাম দম্পতির একটি ঘরের দাবি করছি।

অপর প্রতিবেশি হোসনেয়ারা বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘরের তালিকা যারা করেছেন তারা যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে রাহানা বেগমের নাম আসতো। সে একটি ঘর পেয়ে উপকৃত হতো। রাহানা বেগমের পরিবারের জন্য সরকারি বেসরকারি সহযোগিতার দাবি করছি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত লুৎফর রহমান জানান, টাকা নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য সোরমান মিয়া বলেন, ঘর হস্তান্তরের উপকারভোগীদের তালিকা আমাদের কাছ থেকে নেয়নি। ঘর বরাদ্ধে নিয়োজিতা কর্মীরা দায়সারাভাবে তালিকা করেছে। যে কারণে রাহানা বেগমের মতো আরো অনেকেই বাদ পড়েছে। তারপরও বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগত তহবিল থেকে রাহানা বেগমকে সহযোগিতা করা হয়। রাহানা বেগম ঘর পাওয়ার যোগ্য। 

গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজ কুমার বলেন, রাহানা বেগম আমার কাছে আসছিলো। তার নামসহ আরো ৮/১০ জনের নাম দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমাদের তালিকা গুলো ইউএনও অফিস থেকে গ্রহণ করেনি। তবে এক বছর আগে যে তালিকা দেয়া হয়েছিলো সেই তালিকা থেকে ঘর দেয়া হয়েছে বলেন ইউএন অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়েছে। 

টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রানুয়ারা খাতুন বলেন, চেয়ারম্যানের তালিকা অনুযায়ি গালা ইউনিয়নে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। দুই ধাপে গালা ইউনিয়নের মুজিববর্ষের ৫৪ টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। রাহানা বেগম দম্পত্তির তথ্য যাচাই বাছাই করে সরকারি সহায়তা দেয়া হবে।