সৌদি আরবে সড়ক দূর্ঘটনা

ছুটিতে বাড়ি ফেরা হলো না আল আমিনের

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪০ পিএম, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২০ | ৫৮২

অভাবে তারনায় প্রায় এক যুগ আগে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আল আমিন (৩৬)। উদ্দেশ্য ছিলো দুঃখের সংসারে সামান্য স্বচ্ছলতা আনা। দীর্ঘ সময়ের প্রবাস জীবন থেকে গত ৫ বছর আগে একবার এসেছিলেন নিজ দেশে। পরিবারের ইচ্ছাঢ বিয়ে করেছিলেন বিলকিসকে।

বিয়ের সামান্য কদিন পরই প্রিয়তমা স্ত্রী আর বাবা মাকে রেখে আবারও পাড়ি জমান সৌদি আরবে। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে দেশে আসার কথা ছিলো তার। কিন্তু তার আগে তিনি ছুটি নিলেন পৃথিবী থেকে।

গতকাল বুধবার সৌদি আরবের জেদ্দায় মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন আল আমিন সহ আরও দুই বাংলাদেশী। তারা হলেন, নরসিংদীর কাওছার ও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের শাকিল।

জানা যায়, গতকাল বুধবার সৌদি স্থানীয় সময় দুপুরে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলো আল আমিন ও তার দুই স্বদেশী। তারা তিনজনই সৌদি ইয়ামামা কোম্পানিতে পরিছন্নতা কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারটিও চালাচ্ছিলেন আল আমিন। ফেরার পথে জেদ্দার হাইয়াল সামির এলাকায় তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারটিকে অপর একটি বড় লরী ধাক্কা দেয়। এতে দুমড়ে মুচরে যায় আল আমিনদের বহরকারী প্রাইভেটকারটি। আর এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান গাড়িতে থাকা তিনজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সৌদি রেড ক্রিসেন্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিভিল ডিফেন্সের জরুরি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জেদ্দা বাদশাহ আব্দুল আজিজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে তাদের মরদেহ।

এদিকে বুধবার রাতে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি ইউনিয়নের আউলাতৈলে আল আমিনের গ্রামের বাড়িতে তার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছলে সেখানে শুরু হয় শোকের মাতম।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা ফরহাদ আলী ও মা খাতু বেগম।

তার পরিবারের সদস্যরা জানান, দুই ভাই-বোনের মধ্যে আল আমিন ছিলেন সবার বড়। তার ছোট এক বোন রয়েছে। প্রায় ১১ বছর আগে বাবা ফরহাদ আলী ধার দেনা করে আল আমিনকে সৌদি আরব পাঠান। সেখানে যাবার পর প্রথমে আল ওয়ান কোম্পানীতে কাজ শুরু করেন আল আমিন। ছেলের পাঠানো অর্থ দিয়ে ভালোই চলছিলো তাদের সংসার। আল আমিনকে বিদেশ পাঠানোর জন্য করা ঋণও পরিশোধ করে ছিলেন তারা। পরে গত ৫ বছর আগে দেশে এসে বাবা-মায়ের পছন্দে পাশর্^বর্তী আউলিয়াবাদ গ্রামের বাবুল আক্তারের মেয়ে বিলকিস বেগমকে বিয়ে করেন আল আমিন। কিন্তু দেশে তেমন কিছু করতে না পাড়ায় আবারও সুদে ৩ লাখ টাকা ধার করে প্রবাস জীবনে ফিরে যান তিনি। গত তিন বছর আগে জেদ্দার ইয়ামামা নামের একটি ক্লিনিং কোম্পানীতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগ দেন তিনি। দাম্পত্য জীবনে এখনো কোন সন্তানাদি হয়নি তার স্ত্রীর। আগামী মাসের ১০ তারিখে অসুস্থ বাবা মা কে দেখতে দেশে আসার কথা ছিলো তার।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আল আমিনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা ফরহাদ আলী। মা খাতু বেগম ও স্ত্রী বিলকিস বেগম বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। তাদের সান্তনা দিতে ভির করেছেন নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা।

আল আমিনের বাবা ফরহাদ আলী বলেন, দুদিন আগেও ছেলের সাথে কথা হয়েছে। কদিন পর দেশে আসবে সেটাও বলেছে। কিন্তু তার আগেই এমন খবর এলো। আমি অসুস্থ, রোজগার করতে পারি না। আল আমিনই সংসার চালাতো। গেলো বার বিদেশে যাবার সময় সুদে ৩ লাখ টাকা ধার করেছিলো। সেটি এখনও পুরো শেষ পরিশোধ হয়নি। আমার আর ওর মার মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। সেটিও হয়তো এখন বন্ধ হয়ে যাবে।

আল আমিনের স্ত্রী বিলকিস বেগম বলেন, স্বামীর পাঠানো টাকায় ভালোই চলছিলো তাদের সংসার। আর কদিন পর ছুটিতে দেশে আসার কথাও ছিলো। কিন্তু তার আগেই আমাদের থেকে ছুটি নিয়ে পালিয়ে গেলো। একবার বলে যাবারও সুযোগ পেলো না। এসময় সরকারের কাছে আল আমিনের লাশ এনে দেয়ার দাবিও তুলেন তিনি।

আল আমিনের পরিবারকে সান্তনা দিতে আসা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেন, এই পরিবারের হাল ধরার মতো এখন আর কেউ নেই। তাদের পক্ষে আল আমিনের লাশ আনাও সম্ভব না। একমাত্র সরকার যদি এখন সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে তার লাশ আনার ব্যবস্থা করে, তবেই হয়তো তারা মৃতদেহটা অন্তত একবার দেখতে পারবে। আমরা স্থানীয় ভাবে যতটুকু সম্ভব তাদের সহযোগীতা করবো।