রণদা প্রসাদ হত্যা, কুখ্যাত রাজাকার মাহাবুবের ফাঁসির আদেশ

শামসুল ইসলা সহিদ
প্রকাশিত: ০১:০৪ এএম, বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০১৯ | ১২৫৭

৭১,র মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এশিয়াখ্যাত কুমুদিনী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিসহ ৬০জনকে হত্যার ঘটনায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মাহবুবুর রহমানকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতীক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই রায় দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও আবু আহমেদ জমাদার।আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, তার সঙ্গে ছিলেন মো. মোখলেসুর রহমান বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি, তাপস কান্তি বল ও জেসমিন সুলতানা চমন। অন্যদিকে, আসামিপক্ষে ছিলেন গাজি এমএইচ তামিম।

মামলার আরজিতে বলা হয়, আসামি মাহবুবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মে মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ২০ থেকে ২৫ জন সদস্যকে নিয়ে রণদাপ্রসাদ সাহার বাসায় অভিযান চালান। অভিযানে রণদাপ্রসাদ সাহা, তাঁর ছেলে ভবানীপ্রসাদ সাহা, রণদাপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ সহচর গৌর গোপাল সাহা, রাখাল মতলব, রণদাপ্রসাদ সাহার দারোয়ানসহ সাতজনকে অপহরণ করে নিয়ে যান। পরে সবাইকে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর তাঁদের মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। এর আগে রাজাকার মাহবুব তার ভাই মান্নান এবং তার বাবা মাওলানা ওয়াদধ পাকিস্তানী হানাদারদের সহায়তায় মির্জাপুরে গণহত্যা চালায়।

এরআগে উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ২৪ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।

গত বছরের ২৮ মার্চ মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি এই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

রণদা প্রসাদ সাহা হত্যায় অভিযুক্ত টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও গণহত্যার তিনটি অভিযোগ আনা হয়।

গত বছরের ২ নভেম্বর মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা। আসামি মাহবুবুর রহমানের বাবা আব্দুল মাওলানা ওয়াদুদ মুক্তিযুদ্ধের সময় মির্জাপুর শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। মাহবুবুর রাহমান ও তার ভাই আব্দুল মান্নান সে সময় রাজাকার বাহিনীতে ছিলেন। তাদের দাপটে এলাকার সাধারণ নিরীহ মানুষ সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। কাধে রাইফেল নিয়ে তারা দুই ভাই প্রকাশ্যে মির্জাপুরে চলাফেরা করতেন।আসামি একসময় জামায়াতে ইসলামির সমর্থক ছিলেন। তিনি নির্দলীয়ভাবে দুইবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং একবার পৌর মেয়র পদে ।নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও প্রতিবারই পরাজিত হন।

রণদা প্রসাদ সাহার পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়াখ্যাত ৭৫০ শয্যা বিশিষ্ঠ কুমুদিনী হাসপাতাল। এই হামপাতালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামুল্যে চিকিৎসা দেয়া হত। এজন্যই মুলত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং স্থানীয় রাজাকারা রণদা প্রসাদ সহাকে টার্গেট করে। তাছাড়া নারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতেশ্বরী হোমস, টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ এবং মানিকগঞ্জে বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন দেবেন্দ্র কলেজ। তাছাড়াও মির্জাপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।একসময় নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন রণদা প্রসাদ সাহা। থাকতেন নারায়ণগঞ্জের খানপুরের সিরাজদিখানে। সে বাড়ি থেকেই তাকে, তার ছেলে ও অন্যদের ধরে নিয়ে যান আসামি মাহবুবুর রহমান ও তার সহযোগীরা।

স্থানীয় সংসদ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন বলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই রায়ে আমি সন্তুষ্ট। মির্জাপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন ঘটেছে এই রায়ে। তিনি এই রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান।

ভাষা সৈনিক এবং কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালক (শিক্ষা) প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন আইন সবার জন্য সমান, এই রায়ে তাই প্রতীয়মান হয়। এই রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয় সরকারের প্রতি সেই আহবান জানান তিনি।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস বলেন রাজাকার মাহাবুবের ফাঁসির আদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। এই রায়টি দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান তিনি।