ভূঞাপুরে মৃৎশিল্পী বিলুপ্তির পথে

ভূঞাপুর সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:৩৮ পিএম, রোববার, ৩০ জুলাই ২০১৭ | ৩৩০
মৃৎশিল্পীরা ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে নিপুন হাতে কারু কাজের মাধ্যমে মাটি দিয়ে তৈরি করে থাকেন নানা তৈজসপত্র। তাদের জীবন জীবিকার হাতিয়ার হলো মাটি কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের ভালোবাসার জীবিকা ফিকে হতে বসেছে। দিন যতই যাচ্ছে, ততই বাড়ছে আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতা বাড়ার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্প পণ্যগুলো। এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের প্রচুর ব্যবহার ছিল। সেই তৈজসত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্র। এসবের দাম বেশি হলে ও অধিক টেকসই। তাই টাকা বেশি হলেও এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্রই কিনে থাকে সাধারণ মানুষেরা। কাঁচ, পাস্টিক আর মেলামাইনের ভিড়ে এখন মাটির তৈরি ঐ জিনিসপত্র গুলো প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে পাড়ছে না। জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ও ফলদা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের কুমার পাড়ায় ২০০টি কুমার পরিবার বসবাস করছে। এর মধ্যে ৮০টি পরিবার সরাসরি মৃৎ শিল্পের উপর নির্ভশীল। দিন রাত একাকার করে মাটি দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন মৃৎ-পণ্য কিন্তু সঠিক দাম নাম পাওয়ায় আর বর্তমান অবস্থায় কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে এ সকল কারিগররা। বর্তমানে গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব, মেলায় তৈরি খেলনা পুতুল ছাড়া অন্য কোন মৃৎ শিল্পের গ্রাহক নেই বললেই চলে। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। ফলে এ পেশায় জড়িত বিশেষ করে এটাই যাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন তাদের জীবনযাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মৃৎ শিল্পীরা মাটি দিয়ে তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাত, হাঁড়ি পাতিল সহ বিভিন্ন নৃত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পরে সেগুলোকে তারা শহরের দোকান এবং বাসা বাড়িতে বিক্রয় করে থাকেন কিন্তু কালের বিবর্তনে মৃৎ শিল্পের ব্যবহার তেমন এখন চোখেই পরে না, এখন সৌখিন জিনিসপত্র এবং কূয়ার পাতই একমাত্র ভরসা। গোবিন্দাসীর কয়েড়ার মৃৎ শিল্পের পুরনো কারিগর হরি পাল (৬০) জানান, এখন মাটির তৈরি কোন কিছু মানুষ কিনতে না। এখন পাস্টিক আর কাঁচের তৈরি বিভিন্ন ধরণের খেলনা ও শো পিচ কিনতে সবাই ব্যস্ত। রামেন্দ পাল নামে আরেক কারিগর বলেন, আমাদের তৈরি মৃৎ-শিল্পের বাজারদর ভালো ছিল কিন্তু পাস্টিক আর কাঁচের ব্যবহার বাড়ার কারনে আজ আমাদের ব্যবসা ধ্বংসের পথে। এতে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এ বিষয়ে ভূূঞাপুর গোবিন্দাসীর মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী গনেশ পাল দৈনিক টাঙ্গাইল সময়কে বলেন, আগে আমাদের ব্যবসা ভাল চলত। আগে যখন শিসা, প্লাস্টিকের মাল ছিল না তখন আমরা রমরমা ব্যবসা করতাম। আর এখন মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নেই। এখন মাটির জিনিস চলে কম। অন্যান্য কাজ করে আমরা এগিয়ে যাই কিন্তু আমরা মাটির কাজ করে এগিয়ে যেতে পারছি না। আমার বয়স যখন ১০-১২ বছর তখন আমি ২ টাকা থেকে ৫ টাকা করে পাতিল বিক্রি করতাম। আগে অনেক লোকজনই এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে যে পরিমাণে বিক্রি হতো, তার থেকে এখন ৪ ভাগের ১ ভাগ বিক্রি হয়। আবার অনেক সময় চলেই না। এখন আমাদের এ ব্যবসায় একেবারেই অচল। যারা এ ব্যবসায় স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছে, তারা একদমই চলতে পারে না। মৃৎশিল্প ভ্রামমাণ ব্যবসায়ী মহন পাল বলেন, আমাদের এই ব্যবসায় এখন ১৬ আনার মধ্য ৪ আনা চলে, ১২ আনাই চলে না। আমাদের ছেলে-মেয়ে আছে, ছেলে- মেয়েদের লেখা-পড়া করাতে গেলে যে অর্থের দরকার, এই ব্যবসায় থেকে তা উঠানো যায় না। চাকরির ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১৪ লাখ টাকা লাগতেছে এই টাকা দিবে কে। আর এই জন্যই আমরা ভাত পাই বা না পাই বাধ্য হয়েই এই কাজ করতেছি। মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী সন্ধা রাণী বলেন, আমাদের এই ব্যবসায় এখন চলে না, এই ব্যবসায় এখন কোন ভেলু নাই। বৃদ্ধ বয়সে এখন কি করব, তাই জোর করেই এই ব্যবসায় করি। সিলভার, প্লাস্টিক, স্টিলের পণ্য নামার কারণে এই ব্যবসায় অচল হয়ে যাচ্ছে। কসলি, হাড়ি পাতিল এগুলো এখন একদমই চলে না। এই কাজ করে আমাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানো খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। তিনি আরো জানান আধুনিক তৈজসপত্র- পত্রের প্রতিযোগীতায় হেরে গিয়ে বিলুপ্তির পথেই এগিয়ে চলছে এখন মৃৎশিল্প।