মধুপুরে টানা বর্ষণে কেড়ে নিল কৃষকের হাসি


টাঙ্গাইলের মধুপুরে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে উত্তর টাঙ্গাইলের শস্য ভান্ডার ধনবাড়ী,ঘাটাইল সহ মধুপুর উপজেলার বিখ্যাত হাওদা বিলের কয়েক হাজার হেক্টর ইরি-বোরো ধান জলাবদ্ধতায় তলিয়ে গেছে। জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ, সেই সঙ্গে শাক-সবজি সহ বছরের প্রধান ফসল ব্যয়বহুল খরচে চাষ করা অধিক ফলনের ইরি-বোরো ধান চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
টানা বর্ষণের কারণে মাঠে ও বাড়ীতে কৃষকের ধান নষ্ট হচ্ছে কৃষকের মুখের হাসি ম্লান হয়ে গেছে। শহরের নিচু জায়গা ও রাস্তায় পানি জমে গেছে। সর্ব সাধারণের চলাচলসহ বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও দিনমজুরদের মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে শহরে রিক্সা, অটোরিক্সা কমে গেছে। অনেক স্থানে ক্ষেতের ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ভারী বৃষ্টির কারণে বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফসলের অবস্থা খুব ভালো ছিল। আগাম চাষ করা ধান পেকে গেছে। চাষীরা এ ধান কাটতেও শুরু করেছে। বাকি ধানের ৯০ ভাগে শীষ বের হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার থেকে অবিরাম বর্ষণের সঙ্গে দমকা হাওয়ায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চাষীর মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়ায় মাঠের পর মাঠের ধান গাছ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এসব ধানের উপর পানি জমায় ব্যাপক ফলন বিপর্যয় ঘটার শঙ্কায় প্রান্তিক চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
উপজলার অরনখোলা ও কুড়াগাছা ইউনিয়নের মাঝখানে অবস্থিত এ বিল। প্রায় ২১ কিঃ দৈর্ঘ্যের বিলের দু'ধারে উচু পাহাড়। মাঝে মাঝে ছোট বড় কয়েকটি খাল এসে পড়েছে এ বিলে। উজানের বৃহৎ অঞ্চলের সহ আরো, বেশ কয়েকটি অঞ্চলের পানি খালের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে এ বিলে এসে পরে এবং দু'পাশের উচু পাহাড়ের সকল পানি বিলে নেমে আসে। এ কারণে বিশাল এ বিল পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যায়। গত ৩ দিনের অতিবর্ষনে বিলে চাষকৃত শত শত কৃষকের কয়েক হাজার হেক্টর প্রায় পরিনত ইরি-বুরো এখন পানির নীচে।
বিল হতে পানি নিষ্কাষনের মুখ ভরাট ও পানি প্রবাহিত হওয়ার একমাত্র সংযোগ খাল "গুজাখালটি" সংস্কারের অভাবে পানি কাছের বংশাই নদে প্রবাহিত হতে পারেনা, ফলে বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মূল্যবান ফসল তলিয়ে কৃৃষক নিঃস্ব হচ্ছে। পরিতাপের বিষয় গত বৎসরও আগাম বর্ষনে জলাবদ্ধাতায় কৃষকগন সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
জাতীয় দৈনিক আমার সংবাদ, ভোরের ডাক পত্রিকাসহ একাধিক পত্রিকায় সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশের পর উপজেলা কৃষিকর্মকর্তাসহ কর্তৃপক্ষ , নেতৃবৃন্দ ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। কৃষকগন বিলের পানি নিস্কাষনে গুজাখালটি সংস্কারের আবেদনও করেছিল কর্তৃপক্ষের নিকট। দুঃখের বিষয় কাজের কাজ কিছু হয়নি। এ বৎসর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আরো বেশী।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, এ বছর উপজেলায় ১১ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে উফসী ও স্থানীয় জাতের আমন চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে পানিতে ডুবে থাকায় ৫% ক্ষতির আশঙ্কা আছে এবং ৪২ হেক্টর জমিতে কলা, পেঁপে, পান বরজ ও মৌসুমী সবজি চাষ করা হয়েছে তার মধ্যে ১০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়নের হাওদা বিল এলাকার তিন ভাগের দুই ভাগই পানিতে ডুবে গেছে। কুড়ালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামেও ভারী বৃষ্টির কারনে ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক। তিনি আরো বলেন-বিলের পানি নিষ্কাষন সংযোগ খালটি সংস্কার না করা হলে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। এটি সংস্কার করা জরুরী প্রয়োজন।
এদিকে যারা ধান কেটে বাড়ীতে এনেছেন তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। শুকাতে না পারায় ঘরেই নষ্ট হচ্ছে ধান। খড়েও ধরেছে পচন। ঘাটাইলের বাইচাইল গ্রামের গ্রহিনী পারভীন আক্তার জানান, ৪/৫ দিন ধরে ধান কাটা হয়েছে, কিন্তু বৃষ্টির কারণে সিদ্ধ ধান শুকাতে পারছি না। চাপড়ী বাজারের ধান ব্যবসায়ী মো.আব্দুল হাই তালুকদার জানান, বৃষ্টির কারণে ধান বেচা-কেনাও করতে পারছি না।
অপরদিকে, ধনবাড়ী উপজেলার দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠে মাঠে এখন পাঁকা সোনালী ধান। ধনবাড়ী উপজেলাতেও অতি টানা বৃষ্টির কারনে উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের শ্যামলা বিল, বানিয়াজান ইউনিয়নের চৈয় বিল, পানিতে পাকা ধান কাটতে হচ্ছে ও শ্রমিক সংকটের কারণে ১ মণ ধানের মূল্যে দিয়েও একজন শ্রমিক মিলছে না।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় ১০ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এতে হেক্টর প্রতি কৃষকরা সাত থেকে আট মেট্রিক টন ধান পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কৃষকরা জানায়, কমবেশি সব এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। তাই শ্রমিকদের চাহিদা বেশি। এ বছর শ্রমিকের মূল্য বেশি থাকায় স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থীরা ধান কাটার কাজে লেগে পড়েছে।
বীরতারা ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামের কৃষক হাবিবুর বরহমান হাবিব,নূরুল ইসলাম বাবুল,মোজ্জামেল হক, এছাহাক আলী,রইচ উদ্দিন, বাদল এরা সকলেই জানায়, এবার ধানের শীষ মারা যাচ্ছে, তার মধ্যে ঝড়ে শীল পড়ে ধান নষ্ট হয়েগেছে। তার মধ্যে ধানের দাম কম, এক মন ধান বিক্রি করে একজন শ্রমিকের একদিনের মজুরী দেওয়া যায় না।
পাইস্কা ইউনিয়নের দরিচন্দবাড়ী গ্রামের কৃষক নাসির উদ্দিন, কয়ড়া গ্রামের কৃষক জয়নাল এরা জানান, তিনি এবার ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। বাজারে ধানের চাহিদা ও বাজার মূল্য অনেক কম থাকায় তাকে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ধনবাড়ী উপজেলা কৃষি সম্পসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, এবার বোরো ধানের দাম কম থাকায় তারা কৃষকদের ধান ভালভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। যাতে সংরক্ষিত ধান কৃষকরা পরে বিক্রি করে ভাল দাম পায়।
হাফিজুর রহমান