চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন রাজীব হোসেন


আজ বুধবার সকালে পটুয়াখালীর উপজেলা সদরের দাসপাড়ায় নানা লাল মিয়ার বাড়িতে রাজীবকে দাফন করা হয়।
পড়াশোনার চাপের কারণে বাড়িতে খুব বেশি যাওয়া হয়ে উঠত না রাজীবের। এমনও হয়েছে, ঈদের সময়ও যেতে পারেননি তিনি। সেই রাজীব গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে লাশ হয়ে ফিরলেন নানা বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামে। মরদেহ বহন করা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি গ্রামে পৌঁছালে পুরো গ্রামজুড়েই যেন শোকের মাতম শুরু হয়। গতকাল সকাল থেকে হাজারো নারী-পুরুষ ভিড় করেন রাজীবের বাড়িতে।
আজ শেষ জানাজার নামাজ পড়ান তাঁর আপন ছোট ভাই সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মো. মেহেদী হাসান। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন সরকারদলীয় চিফ হুইপ ও স্থানীয় সাংসদ আ স ম ফিরোজ, জেলা প্রশাসক মাছুমুর রহমান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান, দাসপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনএম জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ।
চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ হিসেবে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার দিয়েছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে, তিনি আসলে নিশ্চয়ই তার পরিবারকে আরো যথেষ্ট সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ আছে এবং থাকবে এবং আমরা করব।’
জানাজা শেষে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেহেদী হাসান বলেন,‘মা-বাবার আদর ভালোবাসা পাইনি। ভাই-ই ছিল সব। কোনো দিন মা-বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। সেই ভাইকে আজ চিরবিদায় দিলাম। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমাগো দুই ভাইকে এখন কে দেখবে? বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে কিশোর মেহেদী।
রাজীবের আরেক ছোট ভাই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মো. আবদুল্লাহ কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ভাই কখনো রাগ করতেন না। তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন আমাদের দুই ভাইয়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনলে। আর কোনো দিন ভাই কোরআন তিলাওয়াত শুনবেন না।’
প্রচণ্ড অভাবের মধ্যে থেকেও পড়াশোনায় হাল ছাড়েননি রাজীব। সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। রাজীবের ছোট মামা মো. মিরাজ বলেন, ‘অভাবের কারণে আমি পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু অভাব-অনটনের সঙ্গে সংগ্রাম করে রাজীব পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই—নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ভাই দুটির দায়িত্ব নেওয়া। তাঁর সেই লক্ষ্য পূরণের আগেই দুই বাসের রেষারেষিতে জীবন প্রদীপ নিভে গেল।’
২০০৫ সালে রাজীবের মা মারা যান। সে সময় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত সে। ছোট দুই ভাই মেহেদি হাসান বাপ্পি ও মো. আবদুল্লাহর বয়স তখন দুই বছর ও ছয় মাস। থাকতেন নানা বাড়িতেই। শুরুতে তাদের লালন-পালন করতেন নানি পিয়ারা বেগম ও নানা মোকলেচুর রহমান। চার মাস পর নানিও মারা যান। দুই বছর পর মারা যান নানা। স্ত্রীর মৃত্যুর পরই অপ্রকৃতিস্থ রাজীবের বাবা হেলাল উদ্দিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় তিনি মারা যান। অসহায় এই তিন ভাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন খালা জাহানারা বেগম।
খালার বাড়িতে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব রাজধানীতে আসেন। ওঠেন যাত্রাবাড়ীতে একটি মেসে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। ছাত্র পড়াতেন বেশ কয়েকটি। দম ফেলার ফুরসত পাননি। লক্ষ্য ছিল একটাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ভাই দুটির দায়িত্ব নেওয়া। তবে সবাইকে কাঁদিয়ে অকালেই চলে গেলেন তিনি।
গত ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। ওই সময় তাঁর ডান হাতটি বাসের সামান্য বাইরে ছিল। হঠাৎই পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসের গা ঘেঁষে ওভারটেক করার সময় রাজীবের ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পথচারীদের সহায়তায় তাঁকে দ্রুত শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
গত সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজীব মারা যান। পরে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।