রোহিঙ্গাদের ইতিহাস


ইতিহাসের তথ্য মতে, ৭ম শতাব্দীতে প্রথম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বার্মায় আসা শুরু করে। প্রথমদিকের এই মাইগ্র্যান্টরা ছিল আরবের নাবিক, ব্যবসায়ী ও যাযাবর, যারা অর্থনৈতিক কারণে এই অঞ্চলে ভ্রমণ করত। এভাবে বার্মার আরাকান অঞ্চলে ৭ম থেকে ১৩শ শতকে, ১৫শ শতকে এবং ১৮২৬ সালের পর থেকে ব্রিটিশ শাসনামলে তিন ধাপে ধীরে ধীরে মুসলিম বসতি স্থাপন শুরু হয়। ১৮৯১ সালের ব্রিটিশ আদমশুমারি অনুযায়ী, আরাকানে তখন মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৫৮,২৫৫ জন, যা ১৯১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১,৭৮,৬৪৭ জনে।
রোহিঙ্গা সংকট যেভাবে শুরু: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। ১৯৪২ সালের মধ্য জানুয়ারির দিকে জাপান বার্মা আক্রমণ করে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বার্মায় জাপানি সেনাদের হাতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তখন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকেছিল। এছাড়া আরাকানের স্থানীয় রাখাইনদের (বৌদ্ধ মগদের) সঙ্গে এসব উদ্বাস্তু মুসলিম রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু দাঙ্গাও হয়েছিল।
১৯৪৬ সালের মে মাসে রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তাদের প্রস্তাব ছিল রাখাইন প্রদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করে বুথিডং ও মংদৌ নামে দুটি শহরের একত্রীকরণ। এর দুই মাস পর রোহিঙ্গা মুসলিম নেতৃত্ব আকিয়াবে নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে। তখন রোহিঙ্গা মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলাদা প্রদেশ হিসেবে বার্মা থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই স্বাধীনতার দাবি ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যায়। ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৮ সালে জেনারেল নে উইন বার্মার রাখাইন প্রদেশে মুসলিম সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের দমন করতে ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ পরিচালনা করে। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের কারণে মিয়ানমারের মূল কেন্দ্র থেকে উত্তর-পশ্চিমের রাখাইন প্রদেশ বা আরাকান অঞ্চল কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এই সুযোগটি ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো।
বাংলাদেশ কীভাবে রোহিঙ্গা সংকটে জড়াল: ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৮ সালে সামরিক জিয়ার সরকার মুসলিম বিশ্বে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সামরিক সরকারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়। বার্মা থেকে পালিয়ে আসা দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
এই রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার ও উখিয়ায় উদ্বাস্তু হিসেবে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন সহযোগিতা করতে শুরু করে। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের আধা-সামরিক বাহিনী নাসাকা এবং অন্য সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আক্রমণের পর নতুন করে আবার প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
পরবর্তীকালে মাত্র এক থেকে দেড় লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের স্বল্পসংখ্যক জাতিসংঘের নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করলেও বেশিরভাগই কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকে। অবাক করার বিষয় হলো, বাংলাদেশে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে বলে জাতিসংঘ স্বীকার করে।
অথচ কক্সবাজারের স্থানীয়দের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লাখের বেশি। বাস্তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বর্তমানে ৭ লাখেরও বেশি। ফলে ১৯৭৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুটি কেবল বার্মা বা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু ছিল। ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একটি নতুন সমস্যা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের অজানা তথ্য :
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এখন বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত।
* রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৪ সালে মিয়ানমারের রাজা বোডপায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।
*এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা। ব্রিটিশরা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এরপর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়। নামাজ আদায় বাধা দেয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে।
* ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং> রোয়াং রোয়াইঙ্গিয়া রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে।
* আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো। আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সঙ্গে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
* ১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।
* মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য চর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে।
* রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।
* ভাই আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে^ পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদি অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, বিবিসি পাঁচ মিশালি ডেস্ক