ত্রিপুরায় বাঙালী-উপজাতিদের মধ্যে আবারও ফাটল?


ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার ভোটে বিজেপি এবার নির্বাচনী সমঝোতা করেছে উপজাতিদের দল আইপিএফটিয়ের সঙ্গে। যারা মাত্র কয়েক মাস আগেই আলাদা রাজ্যের দাবিতে ত্রিপুরা অচল করে দিয়েছিল। বাঙালীরা ত্রিপুরাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অন্তত ১৯টি উপজাতির বাস ওই রাজ্যে এবং সেখানে দু'পক্ষের মধ্যে সংঘাতের এক রক্তাক্ত ইতিহাসও আছে। রাজ্যে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টকে হঠাতে বিজেপি যেভাবে ত্রিপুরার উপজাতীয় দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, তাতে কি সেখানে জাতিগত বিভাজনের পথই প্রশস্ত হবে কিনা তাই জনমনে বার বার ঘুরে বেড়াচ্ছে।
টিপরাল্যান্ড বা ছোট্ট ত্রিপুরার ভেতরেই উপজাতিরা এই নামেই আলাদা একটি রাজ্য চাইছেন। আর নির্বাচনের আগে বিজেপি সেই টিপরাল্যান্ড সমর্থকদের কাছে টানাতে অশনি সংকেত দেখছেন বামপন্থীরা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বর্ষীয়ান নেতা গৌতম দাস বলেন, আমাদের এখানে শান্তি আর সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করতেই কিন্তু আইপিএফটিয়ের সঙ্গে তাদের হাত মেলানো হয়েছে। তবে এই আলাদা রাজ্যের দাবিও হুট করে হয়েছে তা নয়।
৮০-য়ের দশকে টিএনভির নামে তাদের নেতা বিজয় রাংখল স্বাধীন ত্রিপুরার স্লোগান দিয়েছিলেন। বিদেশি খেদাওয়ের ডাকও উঠেছিল। কিন্তু উপজাতি-অনুপজাতিরা একজোট হয়ে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর ধরে আবার তারা এই স্লোগান তুলেছে এবং সেই টিএনভি থেকেই এই আইপিএফটি সংগঠনের জন্ম।
ত্রিপুরাতে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজীব ভট্টাচার্য আবার পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, সিপিএমের কাছে এ রাজ্যের ত্রিপুরী-জামাতিয়া-চাকমা-রিয়াংদের মতো জনগোষ্ঠীগুলো প্রতারিত হয়েছে বলেই তারা আলাদা রাজ্যের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি বলেন, জনজাতিদের মধ্যে একটাই বার্তা গেছে, যাদের আমরা বিশ্বাস করে শাসন ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম তারা আমাদের এতো বড় ধোঁকা দিল! বাম শাসনে তাদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি বলেই জনজাতিদের মধ্যে একটা আকুতি এসেছিল যে তাদের একটা নিজস্ব পৃথক রাজ্য দরকার।
ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান ডঃ গৌতম চাকমা বলেন, আলাদা রাজ্যের দাবি পূরণ হয়তো এখন সম্ভব নয়, তবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি অন্য কোনও বিকল্প দিলেও দিতেও পারে। তিনি বলেন, রাজ্য নাহোক, টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল একটা হতেই পারে। আসলে আশির দশকের ভয়াবহ দাঙ্গার পর থেকেই এ রাজ্যে শুধু নিজের সংস্কৃতির আলোয় অন্যদের দেখার চেষ্টা তৈরি হয়েছে এবং এখনও সেটা বাড়ছে।
আসলে ত্রিপুরা এমনিতেই অভিবাসীদের রাজ্য। বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা বহুদিন ধরে এখানে এসে বসবাস করছে এবং প্রতিনিয়ত এটা চলছেই। এর ফলে ট্রাইবালদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চারও হয়েছে এবং তারা এখন নিজেদের সুরক্ষার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা চাইছে।
সেটাই মূল কথা। কিন্তু ত্রিপুরার সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন এবারের ভোট রাজ্যে এথনিক ফল্টলাইন বা জাতিগত বিভাজনগুলোকে সামনে এনে দেবে?
এ বিষয়ে উপজাতি সমাজের আধুনিকা তরুণী শর্মিলি চিসিম বলেন, এমনিতে আমাদের এখানে এথনিক রিলেশনশিপ ভালই ছিল। তবে রাজনীতির কারণে তাতে নানা ইস্যু এখন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তা ছাড়া বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে আমাদের কখনও কিন্তু কোনও এথনিক ইস্যু সামলাতে হয়নি।
বাঙালিদের মধ্যে আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব, এমন কী আত্মীয় স্বজনও আছে। ফলে আমি বলব যা হচ্ছে সবটাই রাজনীতির কারণে। শর্মিলি আরও বলেন, আলাদা রাজ্যের দাবি কেন উঠছে সেটাও মানুষকে বুঝতে হবে এবং এই দাবির পেছনে কিছু যথার্থ কারণও আছে।
তবে বিজেপি-আইপিএফটির সমঝোতা রাজ্যে শান্তির জন্য তত ভাল নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা অভিজিৎ বর্মনের। তিনি ঠিকাদারির কাজে গোটা ত্রিপুরা চষে বেড়ান। তিনি বলেন, বর্তমানে যে সিপিএম সরকার আছে তারাই ক্ষমতায় থেকে গেলে কোনও সমস্যা নেই। বাঙালি-ট্রাইবাল মিলেমিশেই থাকতে পারব। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদল হলে অসুবিধা হতে পারে। তা নিয়ে কিছুটা ভয় থেকেই যায়।
অভিজিৎ বলেন, এখন ধরুন যে কোনও কাজে রাজ্যের যেখানে সেখানে, বহু ভেতরেও অনায়াসে চলে যেতে পারি। কিন্তু আইপিএফটি যেভাবে কিছুদিন আগেও দিনের পর দিন রাস্তা আটকে রেখেছিল, অনেকের ওপর হামলা পর্যন্ত করেছিল তাতে তারা ক্ষমতায় এলে কি আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব? উপজাতিদের তরুণ সমাজও এখন অনেক বেশি শিক্ষিত ও আলোকিত।
তাদের একটা ক্রিটিক্যাল ভিউ থাকতে পারে। তবে এখন দরকার একটা সিভিল সোসাইটি যা সেই ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারে। আসলে বাঙালী ও উপজাতিদের মধ্যে আরও বেশি আদানপ্রদান হলেই সমস্যা মিটবে বলেই মনে করেন অনেকেই। তবু ত্রিপুরাতে আগামী দিনে জাতি সংঘাত আবার মাথা চাড়া দেয় কি না সেই আশঙ্কার চোরা স্রোত নিয়েই রাজ্যের মানুষ রোববার ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন। বাঙালীরা যেমন, তেমনি উপজাতিরাও।