সন্তানের জন্য পিতা-মাতার করণীয়

হাফেজ মাওলানা মুফতি মো: রফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৮:১৯ এএম, শনিবার, ৩০ আগস্ট ২০২৫ | ১৯৩

আল্লাহ তাআলা মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি করেছেন। মানুষের পরিবারব্যবস্থা ও প্রজন্মধারাকে টিকিয়ে রাখতে তিনি পিতা-মাতা ও সন্তানের বন্ধনকে এক মহামূল্যবান নিয়ামত হিসেবে দান করেছেন। তাই এই পিতা পুত্রের বন্ধনকে  ক্ষণস্থায়ী জীবনের সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ না রেখে আরো সম্প্রসারিত করে দুনিয়ার জগত ছেড়ে আলমে বারজাখ হয়ে আখেরাত পর্যন্ত নিয়ে যেতে। এজন্য ইসলামের আবেদন হলো, তুমি  তোমার ও তোমার  পরিবারবর্গ বিশেষত সন্তানাদি কে শুধু দুনিয়ার কষ্ট থেকে বাঁচাবার চিন্তা করো না। কেবল দুনিয়ার সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি  কামনা করো না, বরং কবরের আজাব থেকে কিভাবে বাচাবে, জাহান্নামের শাস্তি থেকে কিভাবে নাজাত পাবে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করো।

 আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন -

হে মমিনগণ তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। (সূরা তাহরীম-৬)

সন্তানের  উপর যেমন  পিতা-মাতার হক রয়েছে, তেমনি সন্তানের প্রতিও পিতা-মাতার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ইসলামে এই দায়িত্বকে অবহেলা করা মারাত্মক গোনাহের শামিল।

আমরা কথায় কথায় বলি, জামানা খারাপ, পরিবেশ খারাপ, সমাজ খারাপ, আসলে কোনটাই খারাপ নয় ;বরং আমাদের স্বভাবটাই খারাপ । তাই একটি সুস্থ সমাজ জাতিকে উপহার দিতে হলে একটা সুস্থ পরিবার গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই । আর সুস্থ ও সভ্য পরিবার গড়ে তুলতে হলে সন্তান লালন-পালনে ইসলাম আমাদেরকে যে হিদায়াত, যে দিকনির্দেশনা   দিয়েছে সে অনুযায়ী ধারাবাহিক তা'লিম তারবিয়ত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের সন্তানকে আদর্শ সন্তান রূপে গড়ে তুলতে হবে । তাহলে এ সন্তান দ্বারা আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে । আল্লাহর দরবারেও আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না । 

সন্তান লালন -পালনে আমাদের করণীয় 

 ১. শিশুর কানে আজান ও ইক্বামত বলা 

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে ধুয়ে- মুছে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে এক্বামত দিতে হবে। এতে সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, তাতে কোন পার্থক্য নেই। আমাদের দেশে একটা গলদ রেওয়াজ হয়ে গেছে, তা হলো ছেলে হলে ঘরের বাহিরে আযান দেওয়া হয়, মেয়ে হলে আর আযান দেওয়া হয় না। এতে অসময়ে কোন বাড়ি থেকে আজানের ধনী ভেসে আসলে মানুষ মনে করে, হয়তো ছেলে হয়েছে। এটা ঠিক নয়। ছেলে হোক মেয়ে হোক, দ্বীনের ব্যাপারে সবাই সমান। পৃথিবীতে আগমনের সাথে সাথে সবকিছুর আগে সন্তানের কানে আল্লাহর বড়ত্বের কথা এবং রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর রিসালতের কথা শোনাতে হবে । 

২. মাথা মুন্ডানো 

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিনে তার মাথা মুন্ডন করবে এবং চুলের ওজন অনুযায়ী রুপা বা রূপার মূল্য সদকা করে দিবে। এটা মুস্তাহাব আমল। আজকাল ডাক্তারগণ সাত দিনের মাথায় চুল কামাতে  নিষেধ করেন এবং তারা বলেন, এতে বাচ্চার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়। কথাটা সঠিক নয়। কেননা , 

বান্দার ক্ষতি হবে এমন কোন নির্দেশ শরীয়ত দিতে পারেনা। অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত হয়েছে যে, যদি সন্তানের সপ্তম দিনে চুল না ফেলা হয় তাহলে বাচ্চার অনেক অসুবিধা হয়।  মাথায় বিভিন্ন ধরনের চুলকানি, লুনতি গোটা   হয়, এবং অনেক সময় মাথা ফুলেও যায় ।  

হাদিসে আছে "প্রত্যেক নবজাতকের পক্ষ থেকে 'আকীকাহ করার জরুরী।তোমরা তাদের  পক্ষ থেকে পশু জবাই করবে। আর তাদের থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করবে। আর কষ্টদায়ক বস্তু দূর করার অর্থ হচ্ছে, মাথার চুল মুন্ডানো৷ 

সুন্দর নাম রাখা। 

৩. নবজাতকের জন্য উত্তম নাম রাখা  

পিতা-মাতার দায়িত্ব, নবজাতক শিশুর জন্য একটি সুন্দর শ্রুতি মধুর অর্থবহ নাম রাখা । নাম মানুষের চরিত্র ও ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন—

“তোমরা তোমাদের সন্তানদের সুন্দর নাম দাও।”(সুনানে আবু দাউদ) 

৪. আকীকা ও ইসলামী পরিচয়

সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকীকাহ করা সুন্নত। এ দিন মাথা মুড়িয়ে দেওয়া, সুন্দর নাম রাখা এবং সদকা করা বর্ণিত আছে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন—

“প্রত্যেক শিশু তার আকীকার কারণে বন্ধক থাকে। সপ্তম দিনে তার জন্য পশু যবেহ করা হবে, নামকরণ করা হবে এবং মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হবে।”(সুনান আবু দাউদ)

৫. হালাল রিযিক থেকে সন্তান প্রতিপালন

সন্তানের জন্য পিতা-মাতার জরুরী বিষয়  হলো হালাল রিযিক দ্বারা তার প্রতিপালন করা।সন্তানকে হারাম খাবার থেকে দূরে রাখা ।  হারাম উপার্জনে লালিত সন্তান সঠিক পথে চলতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন—

“কোনো বান্দা তার সন্তানের জন্য যে উপহার দেয়, তার মধ্যে হালাল খাদ্যের চেয়ে উত্তম কিছু নেই।”(সহিহ বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৮৪)

তিরমিযী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রা:থেকে  বর্ণিত রয়েছে তিনি বলেন  -

"হাসান ইবনে আলী (রাসুলের দৌহিত্র) একবার সাদ্কার খেজুর থেকে একটি খেজুর নিয়ে মুখে দিলে রসূল সা: তাকে বলেন; থু ! থু ! ফেলে দাও। তুমি জানো না, আমরা সদকা খাই না। 

৬. সন্তানকে ঈমান ও দ্বীন শিক্ষা দেওয়া

সন্তানের সবচেয়ে বড় হক হলো তাকে ঈমান ও দ্বীন শেখানো। নামাজ, রোজা, হালাল-হারাম এবং ইসলামী আদর্শ শিক্ষা দেওয়া জরুরি।

রাসূল ﷺ বলেন—

“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়বদ্ধ। তোমাদের প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের অভিভাবক, এবং সে তার পরিবার সম্পর্কে জবাবদিহি করবে।”(সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)

কুরআনে ইরশাদ—

“আপনি আপনার পরিবারকে নামাজের নির্দেশ দিন এবং নিজেও তা অব্যাহত রাখুন।”(সুরা ত্বাহা: ১৩২)

৭. উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়া

শিশুর মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বিনয়, দয়া, শিষ্টাচার ও ধৈর্যের গুণাবলি সৃষ্টি করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন—

“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবার-পরিজনের জন্য সর্বোত্তম।”(সুনান তিরমিজি: ৩৮৯৫)

৮. সমান দৃষ্টিতে দেখা ও ন্যায্যতা বজায় রাখা

সন্তানদের মধ্যে অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

রাসূল ﷺ বলেন—

“সন্তানদের মধ্যে দান-অনুদানে সমতা বজায় রাখো। আমি যদি কাউকে পক্ষপাতিত্ব করতে বলতাম, তবে নারীদের ক্ষেত্রে বলতাম।”(সহিহ বুখারি: ২৫৮৭)

৯. উত্তম পরিবেশ প্রদান

শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা পিতা-মাতার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। খারাপ সঙ্গ, খারাপ বইপত্র, অশ্লীলতা ও নষ্টামি থেকে দূরে রাখা অপরিহার্য।

রাসূল ﷺ বলেন—

“মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর চলে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই দেখুক কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।”(সুনান আবু দাউদ: ৪৮৩৩)

১০. দোয়া করা

সন্তানের জন্য দোয়া করা পিতা-মাতার দায়িত্বের অংশ।

কুরআনে বর্ণিত—

“হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সন্তান দাও, যে সৎকর্মশীল হবে।”(সুরা সফফাত: ১০০)

আরেক স্থানে ইরশাদ—

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আমাদের চোখের স্নিগ্ধতা বানাও এবং আমাদের মুত্তাকিদের নেতা করো।”(সুরা ফুরকান: ৭৪)

উপসংহার

ইসলামে সন্তানকে আল্লাহর আমানত মনে করে তার লালন-পালন করা অপরিহার্য। পিতা-মাতার উচিত সন্তানকে হালাল রিযিক খাওয়ানো, আকীকা করা, সুন্দর নাম রাখা, ঈমান-আখলাক শিক্ষা দেওয়া, ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সর্বদা তাদের জন্য দোয়া করা। সন্তানকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল করার জন্য এগুলোই হলো সর্বোত্তম পথ।

লেখক 

হাফেজ মাওলানা মুফতি মো: রফিকুল ইসলাম।

ইমাম ও খতিব টাঙ্গাইল পুরাতন বাস স্ট্যান্ড জামে মসজিদ।