উন্নয়নের ‘উইপোকা’ দমনে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যহত থাকবে। তাঁর সরকার দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ উইপোকায় ধ্বংস করা থেকে রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে দেশের প্রথম কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর মাধ্যমে সকল দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলের বাণিজ্যিক ট্রান্সমিশনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা চলতি বাজেটে ১৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ উইপোকাড়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের প্রতিটি পয়সার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য আমাদের ওইসব উইপোকাকে আটক করতে হবে।’
ডাক ও টেলিয়োগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স-এর (আ্যাটকো) চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী।
এসময় বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড (বিসিএসসিএল)-এর চেয়ারম্যান ড. শাজাহান মাহমুদ অনুষ্ঠানে বাণিজ্যিক সম্প্রচারের জন্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে বিসিএসসিএল-এর সম্পাদিত চুক্তিনামাটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী পরে তা অ্যাটকো চেয়ারম্যানের নিকট হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যহত রাখব। এই সব অপকর্মের সাথে জড়িত থাকলে দল, পরিবার নির্বিশেষে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। আমি দেশের দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী কোন ধরনের প্রপাগান্ডা বা অপপ্রচার না করার জন্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অপপ্রচারগুলো সরকারের বিরোধিতার নামে মানুষের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে আরেকটি আবেদন রাখতে চাই। আপনারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড তুলে ধরুন যাতে করে দেশবাসীর মনে সরকারের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হয় এবং তারাও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা বিরুদ্ধে বলেন, বিরোধিতা করেন, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু মিথ্যা বা অপপ্রচার যেন না হয় সে ব্যাপারে দয়া করে একটু সতর্ক থাকবেন।’
তিনি বলেন, ‘অপপ্রচার বা যাতে দেশ এবং মানুষের মনে অযথা সন্দেহ বা সংঘাত সৃষ্টি করে সে ধরনের সম্প্রচারের বিষয়ে আপনাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কিছু না হোক গোটা ১০ বছরে কিছু কাজতো আমরা করেছি সেটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। সেটাও একটু প্রচার করবেন, সেটাও আমরা চাই। কারণ, আপনি কাজের মধ্যদিয়ে তখনই সফলতা অর্জন করতে পারবেন যখন দেশের মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে।’
‘কাজেই এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে করে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, দিশেহারা হয়ে যায়। যেটুকু ভাল কাজ করেছি সেটুকুর প্রচার অন্তত আমি দাবি করি,’ যোগ করেন তিনি।
তাঁর সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তথ্য কমিশন গঠনের পাশাপাশি নতুন নতুন বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং রেডিওকে অনুমতি দিয়েছে। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নের তথ্যগুলো দয়া করে মানুষের কাছে একটু পৌঁছে দেবেন।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক সম্প্রচারের জন্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় মালিকদের ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।
বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া করে অতীতে সম্প্রচারের জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ হত এখন তা বেঁচে যাওয়ায় সে অর্থ তাঁরা কি কাজে লাগাবেন সে প্রশ্ন উত্থাপন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এর কিছু অংশ ব্যয় করার ও পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলা, দুর্গম পাহাড় বা চর অঞ্চল বা হাওড় অঞ্চলের মানুষের কাছে টেলিমেডিসিন সেবা পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ই-এডুকেশন পদ্ধতি চালুর কথাও তুলে ধরেন।
নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধমে সম্প্রচার শুরু হওয়ায় ইলেকট্রনিক সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর অনেক বাধা দূর হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে পরনির্ভরশীলতা থাকবে না। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলাম।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা আশপাশের দেশগুলোর কাছেও অফার করেছি। তারাও চাইলে এর ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিতে পারবে। এখান থেকেও আমরা অর্থ উপার্জন করতে পারবো। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সহজে বার্তা পৌঁছাবে।’
দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনেও দেশ তৈরী হচ্ছে আভাস দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ‘একটা স্যাটেলাইটের নির্দিষ্ট সময় থাকে ১৫ বছর। এর মধ্যে আরেকটা আমাদের আনতে হবে। এর মধ্যে পাঁচ বছর হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টা তৈরি করা শুরু করেছি, সময় থাকতে নিয়ে আসব। সেটা আমরা একটু বড় আকারে করতে চাই।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁর সন্তান এবং তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়েরও কৃতিত্ব তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী, ডিজিটাল শব্দটি আমি জানতাম না। এটা আমাকে দিয়েছিল সজীব ওয়াজেদ জয়।’
’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর বেসরকারি খাতে টেলিভিশনকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তখন অনেকেই এত অভিজ্ঞ ছিল না, অতোটা সাড়াও পাইনি। কিন্তু যারা চেয়েছিল তাদের সকলকেই টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি দিয়ে দেই।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর একটাই কর্তব্য মনে করি, সেটা হচ্ছে আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, এদেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। সেই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোটাই হচ্ছে আমার একমাত্র কর্তব্য।’
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ বিনির্মাণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কারো কাছে হাত পেতে চলবে না। আজকে আমাদের বাজেটের সমস্ত অর্থ আমাদের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে আসে। আর বিদেশি কিছু ঋণ সহযোগিতা থাকে সেটা ১০ থেকে ১৪ শতাংশের বেশী নয়।
তিনি বলেন, এই নিজস্ব অর্থে নিজের পায়ে দাঁড়াবার যে সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি তা আমাদের ধরে রাখতে হবে।
দেশব্যাপী একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।’
‘কাজেই এই রপ্তানিকে আমরা বহুমুখি করতে চাই। কোন একটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাই না, ’যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ওপর একটি অডিও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা পরিবেশন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিসিএসসিএল-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি চ্যানেল মালিকগণকে অতীতে অ্যাপস্টার-৭ এবং এশিয়া স্যাট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য মেগা হার্টজ প্রতি ফ্রিকোয়েন্সির জন্য প্রতি মাসে ৪ হাজার ডলার ব্যয় করতে হত। সেখানে দেশীয় চ্যানেলগুলোর জন্য প্রতি মাসে স্যাটেলাইটের ভাড়া ২৮১৭ ডলার নির্ধারণ করেছে বিসিএসসিএল।
এর আগে গত ১৯ মে বিসিএসসিএল স্থানীয় ৬টি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চ্যানেলগুলো হচেছ- সময় টিভি, যমুনা টিভি, দিপ্ত টিভি, বিজয় টিভি, বাংলা টিভি এবং মাই টিভি।
এছাড়া বর্তমানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ’র মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাই-১ এর ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। যারমধ্যে ২০টিকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে অন্যগুলো ভাড়া দেওয়া হবে। আয় বাড়াতে ফিলিপাইন, নেপালসহ কাভারেজ পায় এমন দেশগুলোকে স্যাটেলাইট ব্যবহারে আগ্রহী করার উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিসিএসসিএল’র।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে এই চ্যানেলগুলো ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড জানিয়েছে, স্যাটেলাইটটি ব্যবহারের ফলে বছরে আয় হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
গত ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে উৎক্ষেপণের প্রায় ছয় মাস পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর দায়িত্ব বুঝে পায় বাংলাদেশে স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড-বিসিএসসিএল।